রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

স্বাধীনতা : আত্মসত্তার মুখোমুখি

আমরা স্বাধীন -- এ কথাটা কতোখানি সত্যি? একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর পাকসেনাদের আত্মসমর্পনের নাম কি স্বাধীনতা? স্বাধীনতার অর্থ কিংবা সংজ্ঞা কী? এসব প্রশ্ন প্রায়ই কাজ করে আমাদের অন্তরে। আমরা জবাব খুঁজে পাই না কিংবা পেলেও সেই জবাবে তৃপ্ত হতে পারি না। কীভাবে তৃপ্ত হবো; যদি বৃটিশ-ভারত-পাকিস্তান আমলের বাংলার সাথে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের চারিত্রিক কোনো ব্যবধান দেখতে না পাই? পূর্বের অবস্থায় থাকার জন্যে কি আমরা এতো রক্ত আর প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলাম? আমি ইতোপূর্বে বেশ কিছু লেখায় বলেছি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা লড়েছেন তাঁদের স্বপ্ন নিয়ে অভিলাষীদের মতানৈক্য থাকতে পারে, তবে তাঁদের স্বাধীনতার স্বপ্নে কোনো খাঁদ ছিলো না। দীর্ঘ সময়ের মুক্তিযোদ্ধাদের চিন্তা-চেতনায় আদর্শগত মতানৈক্য থাকতেই পারে, তবে স্বপ্ন তাঁদের একটাই ছিলো -- স্বাধীনতা। আদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁরা এ দেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্থিতিশীল দেখার স্বপ্নে অভিন্ন ছিলেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁরা হয়তো এমন দেশের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে নাগরিকরা সুখের দিনে স্বাধীনভাবে হাসতে ও দুঃখের দিনে স্বাধীনভাবে কাঁদতে পারেন। তাঁদের এই স্বপ্নটা আমরা পরবর্তীরা কতোখানি বাস্তাবায়িত করতে পেরেছি, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। আমাদের ভাবতে হবে, একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রতি নজর দিলে কেনো আজ হতাশ হয়ে চোখ ফেরাতে হয়? কেনো এই স্বাধীন দেশের কবি লিখতে বাধ্য হলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাব?’ কেনো দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে কবি বললেন -- ‘ডাকাতদের গ্রাম?’ কেনো স্বাধীন দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-চিকিৎসা-বাসস্থান-আইন-শৃঙ্খলা-সততা-মানবতা-ঈমানদারির অবনতি জাতীয় পর্যায়ে চরম আকার ধারণ করলো? কেনো একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে ভিক্ষুক পর্যন্ত নিরাপত্তার অভাবে আতঙ্কিত হতে হয়? এতোসব সমস্যা একটি স্বাধীন দেশে জন্ম নিলো কীভাবে, তা শুধু সরকার কিংবা নেতাদের ভাবনার বিষয় নয়, ভাবতে হবে প্রতিটি নাগরিককেই। একেবারে কেউ যে ভাবছেন না, আমরা তা কিন্তু বলছি না। তবে ভাবনার সারাৎসার থেকে এখনো সমাধানের পথ বেরিয়ে আসে নি। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাবনায় আদর্শগত, চিন্তাগত, অভিজ্ঞতার সারৎসারগত মতানৈক্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে প্রকৃত দেশপ্রেম থাকলে সকল মতানৈক্যের উর্ধে ওঠে ভাবনাসমূহের সমন্বয় করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। অবশ্য এ জন্যে সরকারের পদক্ষেপটা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি এবং দলের উর্ধে ওঠে মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্বটা সরকারকেই নিতে হবে। সরকার, বিরোধীদল এবং সাধারণ নাগরিক দেশ-জাতির উন্নয়নের স্বার্থে আলোচনার টেবিলে বসে সমন্বয়ের ঐকমত্যে আসাটা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়নের পথে মৌলিক সমস্যাগুলো সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার উর্ধে দাঁড়িয়ে প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে, অতঃপর সাধ্যানুসারে বিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান করা আবশ্যক। বর্তমান বাংলাদেশে যাঁরা দেশ ও জাতির সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবছেন, তাঁদের আদর্শগত মতানৈক্যগুলো প্রধানত তিনটি চিন্তায় বিভক্ত: ডান, বাম এবং ইসলামিক। এই তিন ধারার চিন্তকেরা বাংলাদেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর যে মঞ্চসমূহ চিহ্নিত করেছেন, যথাক্রমে সেগুলো হলো: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক। এখানে যে যাঁর মতো করে মত প্রকাশ করেছেন। একটি বাগানের মূল আকর্ষণ হতে পারে বহুজাতিক ফুলের অস্তিত্ব, একটি দেশের মৌলিকত্ব হতে পারে ভিন্নমতের ধারণ। কে, কোথা থেকে, কীভাবে দেখছেন, তা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত। আবার একজন একটি জিনিসকে সময়সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে দেখতে পারেন। শিল্পী মুনেট তাঁর বাড়ির পাশের সেতুকে জীবনের তিন সময়ে তিনভাবে দেখেছেন। যৌবনে অঙ্কিত সেতুটি স্পষ্ট সেতু হিসেবে তুলিতে প্রস্ফূটিত হলেও মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে অঙ্কিত সেতুকে ধোঁয়া ছাড়া কিছুই মনে হয় না। চিকিৎসকদের ভাষ্যানুযায়ী বৃদ্ধ বয়সে শিল্পী মুনেটের চোখে অসুখ হয়ে গিয়েছিলো। এই যে তিনি ঝাপসা সেতু অঙ্কন করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত চোখের অসুবিধার কারণে। তবু শিল্পীর হাতের তুলিতে ভিন্ন আকর্ষণ রয়েছে। যে কোনো জাতি কিংবা সমাজে ভিন্ন মত ভিন্ন চিন্তা থাকা স্রোতশীলতার পরিচয়। ভিন্নমতের বিজ্ঞজনেরা বাংলাদেশের যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন এগুলোতে দেশের অন্তর্গত সমস্যার স্পষ্ট ইঙ্গিত অবশ্যই পাওয়া যায়। যাঁরা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন, তাঁদেরকে এগুলো ধারণ করতে হবে। সবগুলো মানতে হবে তা আবশ্যক নয়, তবে জানতে হবে। আমরা জানি যে, আধুনিক নগর-রাষ্ট্রের নির্বাহী হয় প্রধানত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত: ১. প্রশাসন, ২. রাজনৈতিক কিংবা সামরিক সরকার, ৩. রাজনৈতিক বিরোধীদল। যদিও গণতান্ত্রিকরা বলে থাকেন, জনগণই রাষ্ট্রের মূল পরিচালক। কিন্তু কথাটা বর্তমান পৃথিবীর কোথাও বাস্তবে কার্যকর আছে বলে মনে হয় না। আমরা প্রচলিত বিশ্বের তাত্ত্বিক আলোচনায় কিংবা প্রশাসনিক বাস্তব কর্মে জনগণের ক্ষমতা বলতে শুধু ভোটকে দেখতে পাচ্ছি, তবে তাও যদি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, প্রশাসনিক পরিচালকেরা প্রকৃতপক্ষে দেশের মূল পরিচালক। এখানে রাজনৈতিক সরকার প্রশাসনিক সরকারের কাছে সর্বদাই দায়বদ্ধ থাকেন। রাজনৈতিক সরকারের অবস্থান গাছের বাকলের মতো অস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল, আর প্রশাসনিক সরকারের অবস্থান স্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদী। রাজনৈতিক বিরোধীদল মূলত ছায়া সরকারের ভূমিকায় থাকার কথা ছিলো। একটি সরকারের রাষ্ট্র-পরিচালনার জন্যে যেমন মন্ত্রিপরিষদ থাকে, তেমনি বিরোধীদলেরও ছায়া মন্ত্রিপরিষদ থাকা প্রয়োজন। বিরোধীদলের মন্ত্রীদের দায়িত্ব হলো, সরকারি মন্ত্রীদের কর্মসূচিসমূহ পর্যবেক্ষণ করা। মোটকথা প্রশাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিচালনা, মন্ত্রীদের দায়িত্ব প্রশাসনের কাজগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা এবং রাজনৈতিক সরকারের সাথে প্রশাসনিক সরকারের সমন্বয় করা, আর রাজনৈতিক সরকারের কাজ হলো এমপি এবং বিরোধীদলের সাথে মন্ত্রীদের কাজের সমন্বয় করা, বিরোধীদলের কাজ হলো সরকারের সাথে জনগণের সমন্বয় করা এবং জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজে সরকার উদ্যোগী হলে সরকারকে সাবধান করে দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সংস্কৃতি এখনো গড়ে উঠে নি। এই সমন্বয়ভিত্তিক রাজনীতি যেসব দেশে রয়েছে সেসব দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আমরা দেখতে পাই। অস্থিতিশীল রাজনীতি যে কোনো দেশের উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক এবং তা বাংলাদেশের একটি মৌলিক সমস্যা। আমাদের দেশে এ সমস্যা সৃষ্টির পেছনে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং ঐতিহাসিক অনেকগুলো কারণ অবশ্য আছে। এ কারণসমূহ সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ না নিলে সমস্যার মৌলিক সমাধান করা যাবে না। একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যা মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্যে সাধারণত দায়ী করা হয় পুঁজিবাদী বিশ্বের অশুভ দৃষ্টিকে। এ কথার সাথে আমরা দ্বিমত করবো না, তবে সাথে সাথে আমরা আমাদের সরকার এবং জনগণকে এজন্যে প্রধান দায়ী বলে মনে করতে পারি। কারণ, আমরা যদি নিজেদের ব্যাপারে সচেতন এবং দেশপ্রেমিক থাকতাম তবে বাইরের শত্রু মৌলিক সমস্যা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হতো। বাইরের শত্রুদের এজেন্ডাগুলো তো বাস্তবায়িত হয় আমাদের কারো-না-কারো মাধ্যমে। এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে যে, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সর্বক্ষেত্রে তৈরি করে রেখেছে মূলত দেশীয় বিশ্বাসঘাতকরাই। আমাদের রাজনীতিকরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিংবা কাগজের মধ্যে আদর্শিক সংঘাতের কথা বললেও প্রকৃত পর্যালোচনায় স্পষ্ট যে, আদর্শিক ব্যাপারটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গৌণ। রাজনীতিতে আদর্শিক মতানৈক্য আর দল এবং ব্যক্তিগত সংঘাত এক জিনিস নয়। আমাদের মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ার মূল উৎস দলগত রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থিক সংঘাত। যেহেতু প্রেক্ষাপট পরির্তন হয় নি তাই নতুন করে এই মূহূর্তে কিছু না বলে শুধু বলতে চাই আমাদেরকে অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করে মাঠে কাজে নামতে হবে। হাতে অনেক কাজ। সময়ের খুবই অভাব। স্বার্থপর আর ভণ্ডরা মুখোশের নিচে বসে দেশটার মূল কাঠামো ক্ষয় করে দিচ্ছে। বর্তমানে নেতৃত্বহীন আমরা গোটা জাতি। আমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। নিজে না পারলে সন্তানকে প্রস্তুত করে গড়তে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। থেমে থাকার সুযোগ নেই। দেশের স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্র কাজটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আসুন, নতুন শপথে দেশ গড়ার জন্যে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন