রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

ঝরাপাতার শূন্য সময় (কবিতা)

ঝরাপাতার শূন্য সময় : সৈয়দ মবনু
প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০০৬
প্রকাশক : নগর সাহিত্য ও প্রকাশনা সংস্থা,
১৮/৮ উত্তরণ, বারুতখানা, সিলেট।
মূল্য :৭০ টাকা
............................................................................


চাঁদ-তারা-ফুল
চাঁদ-তারা-ফুলে
কত আশায় সাজাইলাম জীবনের বাসর
একবিন্দু আলপিন শরাব
নিশির নেশায় ভাঙে চাঁদের ভূমি
আলো ঝরে
মায়া জ্বলে
বিরহ-বিচ্ছেদ
খণ্ড খণ্ড পূর্ণিমায় নড়ে ওঠে কৈ মাছ
একলা সময়ের মাথায় পাথরের বোঝা
ভাঙে সাধনার ঘর
জীবনের জলস্রোতে অসাধনে সাধন আমার
বুকে এক খণ্ড পাথর।


পুখতুন মন
একদা রক্তজবা ফুটেছিলো
আধাঁর রাতের সবুজপাতায়
আমি তারে
তুমি ভেবে
দ্রুত যাই পাহাড়ের চূড়ায়
উনুনের প্রথম রুটি
ছিলো তোমার ওড়নার নিচে
সন্ধ্যার মুখোমুখি
পথিকের অপোয়
আমি ভিনদেশী পথিক
করেছিলাম ক্ষণিক যাত্রাবিরতি
তুমি এমন করে মাথা নতিয়ে হাসলে
যেনো ছোঁয়াছুঁয়িতে নতিয়ে পড়া লজ্জাবতী
বাতাসের দেহে জাতীয় পতাকার মতো উড়ছিলো তোমার দুপাট্টা
অতলে বুকছোঁয়া রুটি
তুমি গৌতমের সুজাতা
তুমি পাহাড়ী প্রজাপতি
তোমার হাতের তান্দুরি রুটিতে
বাঁদরের মতো ঝুলছিলো আফগানকুমারীর পুখতুন মন
আমি দীর্ঘ ভ্রমণের কান্তি নিবারণ করি
চেটে খেয়ে সুশীতল জলপানের মতোন
মানবগ্রহ সফর শেষে লজ্জায় নিশ্চিহ্ন হয় আলোর পৃথিবী
মেঘের আড়ালে মুখ লুকোয় সূর্য
আলবার্ট নোবেলের ডিনামাইটের নিচে
প্রতিদিন ধ্বংস হয় কত নিসর্গ
তবু যখন রজনীগন্ধা ফোটে
সফেদ ওড়না মাথায় দিয়ে নিশিতে তার সুবাস ডাকে
ঘুমের ঘোরে বিছানা ছেড়ে উঠি আমি
তোমাকে খুঁজি বেহেস্তের আকাশে
সবুজ পাখির রূপে
নীরব-নিভৃতে চেয়ে থাকি অনন্ত-অসীমের দিকে
বিনাশের মুখোমুখি অন্ধ বাতাসেরে জিগ্যাসি
কেমন আছে বসরার গোলাপ
আর আমার পুখতুনকুমারী?

সংকরায়ন
কাঁঠাল কুশের হলুদ কুসুমে
পাথুরে বিচি
শীতল বাতাসের জরায়ূতে
কাঁদে; লোহার কয়েল
চাতুর্যের আলো-আঁধার
সত্য-মিথ্যার সংকরায়ন
ড্রামাটিক্যাল ফ্যান্টাসি
বিুব্ধ স্বামীর বিবি তালাকের মতো একদিন বেরিয়ে আসে
রঙধনুর সাত রঙ
দয়ালের রঙ্গমঞ্চ
মাতাল মায়ার গ্যালারিতে ভাঙে; আমার আহাদের গাছ
অতলে ভাঙে
ক্রমাগত কালোপাথরের মাঠ
মরুর সাইমুমে উড়ি আমি উত্তপ্ত বালুকণা
প্রভু
আমাকে মা করো
আমার সর্বস্ব রেখে গেলাম
তোমার অদৃশ্য পায়ে।

নেংটা আদর
ঝরাপাতা আরো ঝরে শীতমগ্ন মাংসের রুয়ায়
ঝোড়োদিনে মেঘালয় দীর্ঘ ঝরে
নক্ষত্র ঝরে করচের পাতায়
মনঘাটায় আলোর নোঙর
মায়াঘর উড়ে চলে আকাশের পেটে
চৈত্য দুপুর
নেংটা আদর
জ্বলে
চন্দ্র
সূর্য
সোনাদিন
সখি।


মা করো প্রভু
বৃষ্টিভেজা মৃদু শীতে
সখি আমায় মনের কথা কয়
এত জল
এত বন্যা
জলের স্রোতে আমার ব্যথিত হৃদয়
এত নাদুস নুদুস বৃষ্টি কেনো জালালের শহরে?
কান্তিতে আমার নীলাভ দুঃখ
নীরবে কাঁদে শীতভোরে
একদা সকালের বৃষ্টিতে
আমি দেখি সিলেটের নিরাই বেদনা
সুরমার জলে প্রকৃতির অভিশাপ
অতলে স্মৃতিময় তালতলা
নিজের বলে কিছু নেই
মাটির দেহ পানির অনন্ত স্রোতে
আমার পশম দাঁড়িয়ে কাঁদে সাদা কাপড়ের নিচে
ক্ষমা করো প্রভু
ক্ষমা চাই মানুষের হাতে আক্রান্ত নীলিমার কাছে
আমাদের রাস পেট খেয়েছে জলের ভূমি
ক্ষমা চাই
নদী-নালা, খাল-বিল সবার কাছে।

প্রেমের দোহাই
নিশির শ্রাবণীতে আমায় খুন করো তুমি
মরুর সাইমুমে
মনের সরাইখানায়
ক্রমাগত রক্ত ঝরে
তোমার পাথরী মনের আঘাতে
জ্বলি আমি
বসন্তের দাউ দাউ আগুনে
শ্রাবণের অথৈ জলে ভাসে আমার বেদনা
ভাসি আমি গলিত মোমের বাতি
দোহাই ঈশ্বর
দোহাই তোমার প্রেমের
সবুজ নীলিমায় তুমি নেমে এসো
আরশের সবগুলো দুয়ার খুলে
আমার বিদীর্ণ মনে।

শাহের পরানে নুরের জাহান
আমি ঈশ্বরে নশ্বর হলে
নভোমণ্ডলে দেখি নুরের জাহান
আধাঁরে আমার ফুলের কুসুম
খাদিম পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদে শাহের পরান
আলো জ্বলে
আমি জ্বলি
নীরবে জ্বলে মায়াফুলের কলি
সূর্যের গাঢ় চুম্বন
মায়ার ঘরে বেদনার শিশির ভাঙে
গোপন কথা
আঁধারে আঁধারে আমার বুক কুঁড়ে
নির্জনে জ্বলে
নিঃসঙ্গ গাছের পাতা
সবুজ শ্যামলের ধানক্ষেতে আমি জ্বলে ছাই হই
শাহের পরান
জালালের কৈতর উড়ে আকাশে
তার বুকে লুকিয়ে কাঁদে নিঃসঙ্গ নুরের জাহান।

পুষ্প কাঁদে
সবুজ আঁচলে আবৃত স্মলহিথ পার্ক
পার্কের জলাশয়
গাছগাছালি
হরিৎপায়ে তোমার হেঁটে-যাওয়া মেঠোপথ
আপাদমস্তক আজও আছে
কভেন্ট্রি রোড
মনিস্টিটের লাইব্রেরি
বই
কম্পিউটার
কালো পাহারাদার
তোমার মুখোমুখি হওয়া মাটিখণ্ড
সবই আছে তোমার স্মৃতি নিয়ে
আজ হতে যুগ-যুগান্তর পিছনে
তোমায় রেখেছিলাম মাটির যে ঘরে
বিশ্বাস করো
আজও এখানে পুষ্প কাঁদে পুষ্প বিরহে।

জোনাকি পোকা
একদিন শহরের কালো ঝড়
দাঙ্গা কুকুরের মতো তেড়ে আসে
জল ছেড়ে পালায় রুই-কাতলা-গজার মাছ
আর ঝুরকি-পথে আমি আটকে যাই; কৈইয়াপুটি
ফুলের ডাগর ডাগর চোখে
চোর-চোর ধ্বনিতে
আতংকিত মায়াজালে
ময়ূরীর মতো পেখম মেলে
আমার বন্ধ্যা কৈশোর
চোখাচোখি সবুজপাতার গোসল শেষে
ফুলের কাকুতিতে খুলে যায় প্রাণের পসরা
প্রাণে প্রাণে
বসন্তের হাওয়া
মায়ার ঘরে ঝরে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত
আমি কালের স্বর্গে নিঃসঙ্গ আদম
তবু ভাঙতে পারিনি বাবার প্রভুদর্শন
হাওয়ার মোহে গিলতে পারিনি
গন্দমের দানা
হাওয়া হাওয়া
বুকে তোমার প্রার্থনা
চাঁদের হাটে ক্ষতবিক্ষত মন
আগুনের সাথে ফুলের যুদ্ধ
তোমার কি আজ মনে আছে সখি
পুলিশের তাড়া-খাওয়া মিছিলপালানো সেই জোনাকি পোঁকার কথা?

আম্মার লাউডুগির গাছ
আমি ক্ষয় হলে
সবুজ ফসলে ভরে যায় অদূরের পথ
হলুদ উনুনে
ডিমে ডিমে পাক হয় কুসুমের মন।
শূন্য বুকে ফুটন্ত সময়
বাষ্পে উড়ে প্রেম, কৃতজ্ঞ কারণ;পরমে আমার প্রার্থনা সকল
অতলে থাকে কষ্টের গুঁড়া।
ফুলের সুবাসে নত হয় লৌহের ছাঁচ
মানুষের বাঁকা চোখে ছাই হই আমি
আমি আর আম্মার লাউডুগির গাছ।

রুহেনের সপ্তকুমারী
কবজ ভেঙে উরুবেলায় উড়ে
শ্বাসরুদ্ধ আমার হাইন্জাবেলার পাখি
বোধিবৃক্ষ ভেসে চলে; মনের সাগরে, জোয়ারে, জ্যোৎস্নায়
মান্দা স্বকালে আমি তারে ডাকি
শুকনো গাছের বাতেনি কথা
সুজাতার পায়েস বেদনা খুঁড়ে তাহার গৌতম মনে
ঝাঁক ছেড়ে আমি একলা পাখি
তপস্যা করি মরাগাছের ডালে
কুয়োপারে হাস্য করে রুহেনের সপ্তকুমারী
অতলে ধ্বসে বেদনার পাহাড়
অন্তরে রক্তারক্তি
একদিন মরুতৃষ্ণায় কাঁদিয়াছে মুসার হাড়
নিশুতির মাঝে হাঁটি আমি
নিষ্কৃতি খুঁজি ফেরাউনের সাঁজোয়া ভেঙে
ফেনার সংসার নীলনদে
আমি নিঃসঙ্গ হাঁটি অনন্তের পথে।

আফলাতুন
হুরুবেলা আমি এক আফলাতুন ছিলাম
পাশের বাড়ির ডারউইনেরা গালি দিতেন
ধুত্তরি; বানরের সন্তান
আমি আমার কালিক মায়া
মায়ার শহর তছনছ করে
প্রতিদিন হারাই মহাকালের জানালায়
পৃথিবীর শেষ সূর্যোদয়
গুলবাগিচার শেষ গোলাপ
আমি ছাড়া বাকিরা কি নিয়ে যাবে
একদা কপালপোড়া উঠানে মন কাঁদে আমার
তবু
আশায় আশায় প্রতিদিন জ্বালাই সূর্যের বুকে মায়ের উনুন
চেয়ে থাকে ভেতর শূন্য তালগাছ।

লাইপাতাবনে পোকার বিস্তার
সাঁতার কাটি ফোরাতের জলে
দুই পারে ভাঙনের ধ্বনি
লাইপাতাবনে পোকার বিস্তার
জলে হোসেনের মাতম ধ্বনি
হাওয়ার বাজপাখি ভাঙে
রক্তাক্ত পোলাপ
মন আমার কুয়াশার কবর
মনভোরে
ফোরাতের কোলে
কাঁদিয়া উঠিলো কালের জয়নুল।

গৃহগান
গৃহগান
রে আমার চাঙ্গারির পাখি
মাছরাঙায় রক্তের দাগ
ফোরাতের তীরে বনুয়া সিমার
ঝরে
শিশিরের জলে হোসেনের লউ
সাদা সাদা কাশের বনে।

তবু পাখিরা ঘর বাঁধে শূন্যে শূন্যে
মাটির দেয়ালে আত্মার পেরাক
মায়ার পরশে ঝোলে স্বপন
স্বপ্ন দীর্ঘতর হয় আকাশপথে
পাতাশূন্য সখি-গাছ
পৃথিবী ছোট হয়
হিমালয় ভাঙে প্রতিদিন
বাতাসে পাথরের বোঝা
তবু পাখিরা ঘর বাঁধে
শূন্যে শূন্যে।

ক্ষরণ
নিরাইয়ে নিরাই ভাঙার প্রতিধ্বনি
আলস্য মগজে করাতের দানা
বাতাসে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বলাৎকার
দ্বন্দ্ব
কামড়ে পবনাশ
সমস্বর
ফুল আর বারুদের ঘর
ফুলের ভুলে ফোটে রক্তাক্ত জবা
কুহকের মগজ-কালান্তর
পাহাড়ের পাদদেশে নিদ্রিত আত্মা
আত্মায় আত্মা
অস্তিত্ব অবিনশ্বর
দ্বন্দ্বের বিষফোড়া, অনস্তিত্বে
ঢেলে দাও এক কাতরা কাঁচা লউ
আসহাবে কাহাফের শরীরে।

কলিজা-ভোনা উল্কাপাত
আলো-আধাঁর, দীর্ঘ হাওয়া
বালিশে লবণাক্ত সমুদ্রের জল
বাতাসে বাতাস ভাঙার প্রতিধ্বনি
বাকলের নিচে উঁই-পাহাড়
কুজোঁ
কার্তিকী
কলিজা-ভোনা উল্কাপাত
ক্রমাগত অমাবশ্যা
আমার আহ্লাদে ক্ষয় হয়- তৃষ্ণার্ত।


মৃত্তিকায় লুপ্ত মানুষ
নিশিকে ভাঙি নিভৃতে নিজের ভেতর
ভাঙি নিশিকে অন্ধকারে-খরায়-অগ্নিতাপে
আতিপাতি করে খুঁজি নিজেকে
রুহের কোলাহলে চূর্ণ হই
ভেঙে ভেঙে মিশে যাই কলবের ভেতর
ভাঙি
আবার কখনো মৃত্তিকায় লুপ্ত হই
আদিতে আমি কী ছিলাম......
আমি মানুষ, নাকি প্রতীকী?
গতত প্রলুব্ধ করে- মনসুরীয় প্রশ্নবান।


পরস্পর অন্ধকার
মানুষ, পশুদের কুহক বিভ্রম সন্ধ্যার চিপায়;
নিভৃতে কেকা-ধ্বনি নদী তীরে
মনুষ্য নাস্তিতার
তেল অন্ধকারে পশুরা শিশির ভাঙে
কালিক কামড়
আলো-অন্ধকারে
মানুষের দুই হাঁটু বেদনা করে।


রে আমার অনন্ত দুঃখ
রুহের ধোঁয়া পাথার ডিঙিয়ে বিচূর্ণ রুহে
বাতাসী কলব ঝুলন্ত অপোর মেঠোপথে
তুমি গেলে, খুব দ্রুত ফিনকি দিয়ে গেলে
নিশি কাঁদে।
চোখে জল জোনাকির আলো-অন্ধকারে।
স্মৃতির কবরে বিস্মৃতির পলি জমে
কে আজ পূর্ণিমা ক্ষেতে পুষ্প ঝরাও মগজ চিবিয়ে
কেন তুমি কষ্ট নাড়াও পুরান গোরস্থানে?
জলদেহ বাতাসের কফিনে ঘুমায়
আলোর শরীর ভাঙে মধ্যাহ্ণে
হাওয়ায় অংকুরিত উরি বিচি;
রে আমার অনন্ত দুঃখ।


মৃত্যু
‘ভুল না আমায়’
নারীর কচি কাকুতি
মাটির দেয়ালে আমরা হারাই নর্তকীর নূপুরের ডাকে
নিদ্রিত আত্মায় স্বপ্নের কোলাহল
ঘরের চৌকাঠে কেগো তুমি প্রাণের সন্ধানে?
আমি তোমার আলিঙ্গনে ছোট হই
দায়ে-কাটা মায়ের কুচিকুচি নালিয়ার মতো
সময় যায় সময়ের স্রোতে
স্রোতের নিচে স্বপ্ন গলে পলি হয়
কালিক স্বপ্নপলি ভেসে যায় মহাকালের ধানক্ষেতে
আমরা ছোট হই মায়ার পৃথিবীতে
যার পর নাই ছোট
তারপর নাই; কোন তিলকের দাগ
এভাবে সে আসে ঘরের চৌকাঠে
কাল-মহাকালে স্বপ্নের বিভ্রমে
নিদারুণ দিনে পাতায় পাতায়
সমীপস্থ প্রিয়দের কাছে
সে আসে মৃত্যু হয়ে জলের পরতে।


হেমলক
ঘরের পাশে বরাক মোহনায়
সক্রেটিসের হেমলকে জ্বলে আমার প্লেটোমন
হেমন্তের দুপুর
জলের পর্দা উঠিয়ে সূর্য চিবিয়ে খায় সুরমা নদীর বুক
নদীর চরে কৃষাণের মনে অশুভ পলির নীরব ব্যথা
অদূরে ভাসে আর ডোবে
দুর্গত সুরমা-কুশিয়ারা
মরাগাছ
শুকনো পাতা
বাকলের নিচে ইদিপাসের খড় খড় কান্না
সুরমা নদী ফারাক্কা
শীতের শিশিরে লুকিয়ে কাঁদে জলশূন্য বালুকণা
বর্ষার দুপুরে বন্যার জলে ভাসি আমি
মানুষের চোখের জলে ক্রমাগত ভাসে আমার কবিতা
ওই...............
কে দিয়েছে বাঁধ সুরমার উজানে
বরাক মোহনায়
টিপাইমুখে কিংবা
ফারাক্কায়?
ওরা তারা
যারা কাল-মহাকালের গোপন সময়ে
ঝরায় তাদের অশুভ মগজের গুড়া
আমার কবিতায়
আর
সক্রেটিসের মতো চায়ের কাপে হেমলক দিয়ে
আমাকেও হত্যা করে তারা।

মায়ের শাড়ির আঁচলে
পৃথিবীর নগর নগর ঘুরে পূর্ণিমায় রাত নিশি হলে
ফুলের সুবাসে আমার নেশা হয়
পাখির ঘরে বন্ধ্যা সময়
বাউলার জ্বর জ্বর করে
গুরুর লাল চোখের দেয়াল টপকিয়ে
নগরের হাওয়ায় বগলি
ঠুন্ ঠুন্ শব্দ
সাবুদের মুখোমুখি ইমার্জেন্সি ব্রেইক
নাটাইয়ের ঘুড়ির মতো মায়ের শাড়ির আঁচলে
আমি নীরবে বাঁধি আমার অশান্ত পৃথিবী নদীর মোহনা
চন্দ্রসূর্য্য
গ্রহতারা।


কবি
মাটির চৈতন্যে বসন্ত বাগান
মালিশূন্য জলপাত্রে অসুস্থ সময়
তবু তুমি এলে বাতাসে বাতাসে হাসনাহেনা ফোটে
আমি যে সদাগরির ছলাকলা জানি না
পাথর ভাঙা শিখিনি
শুধু বাতাসে সুবাস উড়াই
জোনাকির বুকে কস্তুরী খুঁজিয়া দিন কাটাই
এটা আমার দোষ নয়
আমি প্রভুর শিষ্য
আমি কবি।


কাঞ্চাসখি
সবুজ গাছের মরাডালে ঝুলে আছে কাঞ্চাসখি
আমার নীলকণ্ঠের বেদনা
বয়ঃসন্ধিকালে সোনালি ঝাঁঝরের আচলে তুমি
নদী তীরের জ্যোৎস্নারাত
নিশিতে জালালের কৈতর উড়ে অদূরে
সখি জলে কি ভাসে পুরান
দিনের মায়াকথা
আমরা তো সূর্যমুখী দুপুরে লুকোচুরি খেলিয়াছি
চানমারির টিলায়
নেউলের মতো খরগোশ তাড়িয়েছি লাক্কাতুরা চা বাগানে
সব চোখে ধুলো দিয়ে লুকাইতাম পূর্ণিমার মেলায়
সবুজ আগুনে পাকিয়ে খেতাম টুপাভাত
তেলাপিয়ার মতো লাইলাই খেলতাম শাহী ঈদগার পুকুরে
সখি এখন পরস্পর শুধু রক্ত খোঁজে
শকুনের দাঁত আলো-আঁধারে
এমন কপালপোড়া নিদানের দিনে
আমি হাটি নিঃসঙ্গ
পির মজিরের নগরে নগরে
কবুতরের মতো জালালের মুসল্লায় নিঃশব্দে খুঁজি
শব্দের দানা
প্রজাপতির ডানায় পূর্ণিমা ঝরে
তবু তুমি আসিলেও আসিতে পার
আগের মতো সোনালি সূর্যের মুখোমুখি প্রভাতী মক্তবে
মেঘেভেজা দেহ নিয়ে পাহাড়ী ঢলে
কিংবা
আমার অনন্তের যাত্রাকালে
কাগজের নৌকা নিয়ে।

তুমি খুনি,আমিও তাই
আমি দীর্ঘদিন সাদা সাদা গুরুন্ডা ফুলের অতলে লুকিয়ে রেখেছি
রসুনের মতো দেখিতে আমার নিঃসঙ্গ বেদনা।
আমি আমার সিনার সবগুলো মুরমুরির ফাঁক দিয়ে খুঁজেছি সখি তোমাকে,
আর বাতাসে উড়ন্ত তোমার কালোকেশে শব্দের দানা।
গভীর নিশির স্কাই-পথে হঠাৎ তোমার কৃষ্ণ কৃষ্ণ ডাক,
তখন আমি উড়ন্ত ছিলাম পুবালি বাতাসে,
তোমার ডাক শোনে নীল আকাশে জমে আমার সিনার নিঃশ্বাসে কালো ধোঁয়া,
সকালের পৃথিবী কালো হয়,
এখানে কালো বৃষ্টি ঝরে,
আমার সিনা-ভাঙা বৃষ্টি।
বৃষ্টির জলে দূরদেশের খুস্ত পাহাড়ের পাদদেশে আষাঢ়ি ঢলে প্রবাহিত নহরে লিজা।
লিজার জলে সাঁতার কেটে আমি বেহেস্তি আদমের নিঃসঙ্গ বেদনা কাতর হয়।
মনে ঝরে রক্ত।
তুমি চামড়ার অতলে লুকিয়ে রাখো তোমার মনের কথা,
আর ক্রমাগত আমার ভাব দেহ থেকে ভারি করো মোবাইল চলনায়।
আমি তোমার পথ চেয়ে নৌকা চালাই বুড়িগঙ্গার জলে।
পথে-পথে যেতে-যেতে যারে দেখি তারে মনে হয় তুমি।
তুমি কি জানো না সখি, সবই মিথ্যা; যা আছে
দুনিয়ার গুলশান-বনানী?
আমি জানি; আলবার্ট নোবেলের ডিনামাইটের নিচে
মানুষ বিধ্বস্ত।
তবুও আমি মানুষের দুর্গতির ফাঁক দিয়ে হেটে হেটে
গাছের কাঁচা আমে খুঁজি আলবার্ট নোবেলের বার্থার।
সখি, তুমি কি হবে আমার কালিক বার্থার?
মানুষ-ই মানুষ খুন করে, তবু আমি মানুষ খুঁজি
তোমার মতো মানুষের ভিড়ে।
হ্যাঁ, আমি তাও জানি, হয়তো তুমি আমার খুনি।
কারণ, তুমি মানুষ,তুমি-ই খুনি।
আমিও তাই।
তুমি যেদিন আমাকে নির্মমভাবে খুন করবে।
নিষ্ঠুর হয়ে পিছনে ফেলে চলে যাবে,
সে দিনও জেনে যেও;
তোমার সাথে আমার ভালোবাসায় মিথ্যা মেকিয়াভেলি ছিলো না।


নিঃসঙ্গ প্রদীপ
আমাদের বড় রাস্তার মোড়ে
সিটি কাউন্সিলের প্রদীপ সারারাত জ্বলে
গভীর নিশিতে আমারে দেখিয়া
তার চোখ থেকে আরো জল ঝরে
এত ব্যথা কিসের তার মনে
জিজ্ঞাসিলে
কেঁদে উঠে গাছ
আল্লার আরশ।


যখন আমি ছিলাম শূন্যে
মিটিমিটি সূর্যের আলোতে ঠেস দিয়ে
সোজাসুজি আমার মুখোমুখি মলাটের ফাঁকে
শিকারির মতো তার দু চোখ
যখন আমি ছিলাম শূন্যে
মহাশূন্যে
জীবন্ত
কিংবা
মৃত
আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ভাঙে-গড়ে
বারংবার প্রশ্ন করে
তুমি কি পাথুরে মানুষ?
আমি মানুষ কি না জানি না
তবে পাথুরে নয়
আমি অন্তর্লোকে বিচূর্ণ হাওয়া ধীমান চোখের একবিন্দু উষ্ণ জল।


ফ্রয়েডের প্রেতাত্মায় নারী
আলোর পৃথিবী নীরবে কেঁদে ওঠে
মরুর সাইমুম ঢেউ তুলে শিশিরে ভেজা-মুসার বুকে
ফেরাউনের শ্বাস-নিঃশ্বাসে ঝিরঝির অন্ধকার
মকরমের কুমড়া গাছে আগুনের ফুল ফোটেমাটি;
তুমি যেদিন মাটিতে মিশে যাবে
সেদিন কোথায় লুকাবে তোমার এত আগুনের হুতামা?
আর আমি কোথায় লুকাই মাটির এত লজ্জা
মেকিয়াভেলির দাঁতের চিবুনিতে নীলিমা
যখন রক্তাক্ত হয়
কিংবা ফ্রয়েড-এর প্রেতাত্মায় নারী আর বরাহের মাংস সমার্থক হলে?
বিনাশী দহন আমাকে প্রতিক্ষণ গ্রাস করে
চোখে ঝরে রুহে উত্থিত বিন্দু বিন্দু জল
রক্তশূন্য মাকড়ের মতো কতকাল বাঁকা হয়ে থাকবে
তোমরা ছদ্ম লান্নতি দল
নববধূ
সোনালি ঝাঁঝরের ঘোমটা সরিয়ে দেখো
নীলিমার বুক ফেটে নীল জল ঝরে
মাটির ঘরে জমাট বাঁধা একখণ্ড শীত
আমাকে ছিন্নভিন্ন করে
রুহানীতে- অন্তরাত্মায়।

হেই কথা কইবার পারছনা
আমি এত মায়া কোথায় রাখুম তর ছোট এই দুনিয়ায়

ক তুই ক
মাটি খুঁড়ে পাতালে তালের মতো আমি পাকাতে চেয়েছিলাম তারে
তার পরশে গজিয়ে ওঠে তালগাছ
বৃক্ষরাজি
লতাপাতা
জল
কীটপতঙ্গ
সমুদ্রের জল
বাষ্প হয়ে উড়ে মেঘে মেঘে আকাশ-বাতাস-পৃথিবী কাঁপিয়ে আসে বিজলি
বজ্রপাত ঝরে বৃষ্টি
হিমালয় পাহাড়ের চূড়ায় গলে বরফ
তুই আমারে হানির মতো মায়া দিলি
ক্যান দিলি


কছনা হেই কথা
নদীর জলস্রোতের মতো ক্যান আমার মায়ার সারাঅঙ্গ
কাজী নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে তুই হেই কথা কইবার পারছনা?
গাঢ়-তীরচোখে রাগ কইরা চাইতাছত ক্যান
একবার আকাশ থাইক্কা নাইমা আয়
মধ্যমাসের চাঁদের মতো প্রাণ খুইলা পূর্ণিমা দে
আমি আমার মায়া রাখুম হেইকানে।

কালিক কানুর বিন্দাবনে
সন্ধ্যার ঝুরকি-পথে
বিদ্যুৎগৃহের হ্যাঁচকা টানে
দু’টি প্রাণের মধ্যখানে
ঝমঝমিয়ে নেমে আসে অন্ধকার
মিনার বাজারে যেনো
মমতাজের টলমল চোখে
দুরভিগম্য মনোপথে
আমি কান্ত
বিরহিত
সম্রাট শাহজাহান
মোমের আলো বাতাসে নড়ে
দূরদেশে ভাঙে তাজমহল
ঢেকুরে আমার জ্বলে-নেভে
আলোআধাঁর
ইউসুফ-জুলেখা
আলোভর্তা
সিদ্ধভাত
কবিতার ছন্দ
বেদনার লেলিহান শিখা
হাড়িতে হাড়ি ভাঙার শব্দ
জীবনের ছন্দপতন
সময়ের মেকিয়াবাদ ডিঙিয়ে আয় তুই কালের রাধা
আলো জ্বালিয়ে আয়
আমার বুকে কালিক কানুর বিন্দাবনে আয়
আমরা প্রেমজলে সেচ লাগিয়ে আত্মায় করি আত্মার চাষ।


নদীর হাড়কালি ছুঁয়ে গেলে
মাটির পৃথিবী নত হয় শূন্যে আমি নীরব হলে
পুরাতন কাগজের মতো নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘূর্ণিতে ওড়ায়
শ্বাসরুদ্ধ করে পৃথিবীর সাথে আইন্জা দিয়ে
অন্ধকারে আমি নিরাই খুঁজি
আমার নিরাই দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের ভিড়ে
নিঃসঙ্গ আমি শত
সঙ্গের মেলায়
পাহাড়ী পিপিলিকার মতো নীলিমা আমার মন খুঁড়ে খায়
নদীর হাড়
কালি আমায় ছুঁয়ে গেলে অন্ধকার ক্ষয় হয় তিতিরের বুকে
শিখার বাড়ির কাছে তার মতো প্রবাহিত নিঃসঙ্গ নদী
নীল কষ্ট খুলে দিলো চুপি চুপি ডেকে
জলের ভেতরে এত নীল বেদনা
আমি নীল হই তার অন্তরঙ্গে
বাড়ির কাছে জলের পাহাড়
তবু লালনপাখি জল-তৃষ্ণায় ওড়ে;
ঈশ্বরে-ঈশ্বরে
নদীতে প্রবহমান জল
আমি আলোয়া
শিকারির মতো দেখি তার নীল রঙ
পাতালে খুঁজি আমারে
পাহাড়ী ধ্বসের মতো মিশে যাই বেদনার পলিতে
সুখের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিই ত্রিকালের আলো-অন্ধকারে।


কিষাণের মেয়ে
বাদলা বিকালের ক্যানারী দ্বীপ
লরেন গাছ নীরবে কাঁদে
রঙধনুর সাত রঙ
ঝুলেছিলো তার নিরলংকার দেহে
দু’জন চোখাচোখি হলে
ঝিলিক দিয়ে উঠে শিশিরে-ভেজা সবুজ ঘাসে সূর্যের কিরণ
মাটির ভারালের অতলে হাসে সোনালি ধানের মন
একদা বৃষ্টিময় নীলাভ দুপুরে
বাবলা গাছের কাটায় ঝুলেছিলো আমার নীল বেদনা
সে এক কৃষানের মেয়ে
চোখের উনুনে জ্বালায় আমার রুহের অন্তরাত্মা।


নিথর প্রেমের লবনাক্ত জল
মায়ার ক্ষেত্রে অঙ্করিত দায়িত্বের বীজ গোপন বাসরে ভাঙে নিথর প্রেমের লবনাক্ত জল। আমায় সওদা করে প্রতিক্ষণ আমার ভালোবাসা। খেলাঘরের ক্ষেতে প্রষ্ফূটিত শান্তনার ফুল ঝরে অসময়ের কালোরাত। মনের চিমটি ঝাকুনি দিয়ে উঠে নিজের অস্তিত্বে। মুসা নবির মতো আমিও গোপনে তোমায় দেখার বিন্দু বিন্দু জলে তুর পাহাড় জ্বালাই। প্রাপ্তিতে তৃপ্তি নাই। দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের যোগসূত্রে আমার মায়াগাছের সকল পাতা ঝেরে বেঁধে দিলাম তোমার ওড়নার মাথায়। বিনিময়ে ভালোবাসা কিংবা ঘৃনা, দু’টা-ই আমার জীবনের অমূল্যধন। তবে, আমি আতংকিত হই, যেদিন তোমার কাকুতি খোঁড়ে না আমার মন।


ক্রন্দন চাই না
তোমার পথে চেয়ে থাকি আমি কান্ত হলে
পূর্ণিমার রাতে শীতের শিশিরে নদীর তীরে
ধানের ক্ষেতে সাদা সাদা কাশফুলের আড়ালে
নীরব সময়ে আমার কান্ত বুকের পাঁজরে
জীবন-মৃত্যুর মধ্যখানে কৃষকের হাসিতে
রজনীগন্ধার সুবাসে তোমার দেহ উড়ে
তোমাকে দেখি আধাঁর রাতে জোনাকির বুকে
আলোর পৃথিবী, বৃষ্টির জলে দেখি তোমাকে
তোমাকে দেখি আমি সবুজ এই বাংলাদেশে
আমি তোমার চোখে শুধু ক্রন্দন দেখতে চাই না
তোমাকে দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে
শোষিতের পাশে, আধাঁরের দেয়াল ভেঙে
পুরান কাঠে দীর্ঘ জাঙ্গার-লাগা লোহার মতো
তোমাকে দাঁড়াতে হবে; শোষকের বিরুদ্ধে
জালেমের সামনে পায়ের গোড়ালি শক্ত করে
শিশাঢালা প্রাচীরের মতো দাঁড়াতে হবে
তুমি মানুষ আর মানবতার মুক্তির মিছিলে
তোমাকে দাঁড়াতে হবে সত্য-ন্যায়ের পথে
কালিক ওমর কিংবা জয়নব আল-গাজ্জালী হয়ে
তুমি যেদিন খালেদের মতো দাঁড়িয়ে যাবে
খাওলার মতো দুপাট্টা মাথায় বেঁধে নেবে
সেদিন পূর্ণিমার চাঁদে রজনীগন্ধা ফুটবে
সবকিছু লুঠিয়ে পরবে তোমার পায়ের নিচে
আমার কস্তুরী বুকে স্বপ্ন দেখি তোমাকে
একদিন তুমি দাঁড়িয়ে যাবে হরিণের চোখে
আমি তোমার দিকে চেয়ে আছি পরান খুলে
তুমি আলোর পৃথিবী, হেরার রাজতোরণ হাতে।


অহম
আমি স্বপ্নবিলাসের শব্দ
বেপারী ছন্দে মালা গেঁথে কালের বাজারে সওদা করি।
মহাজনদের মুখোমুখি
ক্যালকুলেটারে মুনাফার হিসাব খসলে ভাবনার অতলহীন পথে
তোমার দোকানে উৎকৃষ্ট মালের সন্ধানে বারবার ফিরে আসি।
শূন্যে তুমি ভুলের ঘরে ঢিল মেরে প্রতিবারই ভাঙলে আমার চিন্তার শহর।
তবুও আমি কালের ক্ষত-বিক্ষত সময়ের শব্দগুলো মহাকালে গুদামজাতের আগে তোমার মায়ার কষ্টিপাথরে স্পর্শ করে দেখি মালের উৎকৃষ্টতা।
মুনাফার হিসাব ক্যালকুলেটারে খসে মাল ক্রয়ের অভ্যাস খুব একটা নেই বলে আমার অবৈতনিক উপদেষ্টারা উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রচার করেন; হয়তো মহাকালেও গভীর নিশিতে ঐ মিয়ার শূন্যহাতে বাড়ি ফিরতে হবে। শব্দের তেজারতিতে কাল ছেড়ে মহাকালের ভাবনা আমাকে খুব একটা আলোড়িত না করলেও তোমার মুখোমুখি শূন্যহাত প্রতিক্ষণ ভেতরে সঞ্চয় করে গম্ভীরতা। বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমি এখনও আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বাস করি: যদি কোনোদিন আমার পান থেকে চুন খসে তবে আর কারো না হোক তোমার ভেতরে কিছুটা দাগ কাটবে। স্বার্থিকতায় অমাবশ্যার গহীন সময়ে তুমি তোমার জানালাটা বন্ধ করে আমাকে পূর্ণিমা থেকে বঞ্চিত করতে পারো না; এটা আমার আজন্ম বিশ্বাস। আমি হয়তো স্বপ্নবিলাসী, তবে সত্য; আমি আমার আদি বাবা আদমের মতো রক্তমাংসের মানুষ। তোমার দেহের পূর্ণিমা ঝরে আমার ঘরে যে আলো এসেছে, তা দিয়ে আমি এতদিন শব্দের বাজারে স্বপ্নবিলাসের মালা গেঁথে জমজমাট ব্যবসা করেছি। তারপরও মানুষের মতো আমার নিজস্ব একটা অহম আছে। তুমি তোমার ভালোবাসার অহম যদি আমার বাচাল চাঁদের মায়ার মরুতে দ্রুতগামী উটের পায়ে উড়ন্ত বালুকণার মতো বৈশাখী ঝোড়োবেগে শূন্যে শূন্যে কায়ার সরবতা মায়ায় নিথর করে কাঠাল গাছের লালপাতা হয়ে আর না ঝরাও আকাশ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে-পড়া পূর্ণিমার রাত কিংবা আমার মায়ার লবণাক্ত জলে তুমি না গলে যদি হয়ে যাও সাইপ্রাসের বরফের মতো একখণ্ড পাথর, তখন আমার কী করার আছে?


ঝরাপাতার শূন্য সময়
মাটির ছাচে দীর্ঘ ঢেকেছি আমি ঝরাপাতার শূন্য সময়। সেদিন আমাকে আরো শূন্য করে অন্ধকারের মুখোমুখি তোমার এক লুকমা মায়া। সাধনে আমার ভজন তুমি। ভজনের দানায় দানায় মায়ার লেলিহান শিখা। মানুষের আত্মা যখন দখল করে নিয়েছে যন্ত্রের কোলাহল, তখন আমি কালিক বিন্দাবনের কৃষ্ণকলি তোমার আত্মায় খুঁজি আত্মার নৈঃশব্দ গান। তবু কোনো জানি আত্মিকতায় খুব ভয় হয়। আত্মায় আত্মা রাখতে গেলে শুধু আমার ক্ষয় হয়। ভালোবাসাবাসির জগতে বড়-ই কপালপোড়া সখি আমি। অথচ আমারও যে একটা মন আছে।


চাঁদনী
মন কাঁদে
বুকে চাঁদের কালো ব্যথা
বিশাল বটগাছ; বাকলের নিচে বহতা নদী
সাধু মহাজন, পরাশ্রিত জল অদূরের আকাশে পুরান দিনের চাঁদ
রক্তেরাঙা লাল চাঁদ।
চাঁদের আলো-আধাঁরে গভীর নিশিতে ফিরছিলাম আমি, রাজু, রিয়াদ।
হক নানার বাড়ির হালঘাটায় আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় অনেক আগে মরে যাওয়া তার পাহাড়ী লাল ঘোড়া।
আমি চিটকে পড়ি আলো-আধাঁরি পূর্ণিমায়। চারদিক অন্ধকার-তারতেল অন্ধকার অনেক দিন পর বটগাছের বাকলের নিচে চুমরির মতো জেগে ওঠে নীরব-নিস্তব্ধ কালোচাঁদ চাঁদনীহীন কালোরাত।
সামনে মাগুড়া নদী মেকিয়াভেলির আত্মার মতো আজ প্রায় মৃত অথচ এই নদী অনেক কথার নীরব সাক্ষি তারও পরকাষ্টায় ছিলো একদিন অধীরতা সে ছিলো আমার কৈশোরের মতো ধিনিকেষ্ট যৌবনের মতো প্রবহমান খরস্রোতা। সেই সময় ছিলো না এমন সুসংগঠিত পথ।
একদা আমি ফিরছি চাঁদের আলো-আধাঁরে
মেঠোপথ দিয়ে আমি ফিরছি ঢাকা থেকে নিশিতে গোয়ালা বাজার হয়ে বাড়ির পথে আমার সর্বেন্দ্রিয়ে ছিলো তখন নয় মাসের যুদ্ধ যুদ্ধের কান্তি নবজাতক স্বাধীনতার বর্ণালি আনন্দ। আমি দীর্ঘপথ হাঁটি। কান্তি আমায় গ্রাস করে। অতঃপর জেগে উঠি স্বাধীনতার আনন্দে। আমি হাঁটি কান্তি বুকে নিয়ে দ্রুত হাঁটি অদূরে শাহার পাড়া শেষে মাগুড়া নদী অতঃপর সৈয়দপুর; আমার দাদাজির ভিটেবাড়ি। দীর্ঘ যুদ্ধের রক্তভেজা পথে পথে শহিদের লাশ অসংখ্য স্বজনহারা স্বজনের আহাজারি আমি সব ডিঙিয়ে বাড়ির পথে দ্রুত হাঁটি ।গভীর আঁধার রাতে আমার মাথায় বাঁধা ছিলো দু’শ চৌদ্দ বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধের বিজয় সবুজ শ্যামলে উদিত স্বাধীনতার সূর্য্য। আমি হাঁটি ষোলই ডিসেম্বর একাত্তরের নিশিরাতে শরৎ-এর দেবদাসের মতো অবশ দেহে প্রভাতে গ্রামের মানুষের মুখোমুখি হলে সবাই এক সাথে খুলে দিলো রক্তেরাঙা সবুজ পতাকায় আমাদের বেদনা। অদূরে মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনিতে বারবার মনে ঢেউ খেলে মানুষের মুক্তির শ্লোগান। বাতাসে বাতাসে শ্লোগানে মাথা রেখে মানুষের ভিড়ে নীরবে হাঁটি আমি বাড়ির পথে সকালের আলোতে খুঁজি চাঁদনী আমার চাঁদনী। না; তারা কেউ আসেনি! মা বাবা ভাই বোন চাঁদনী আমি দীর্ঘ নয় মাস জীবন মৃত্যুর পথে হেঁটে আজ বাড়ি ফিরছি তবু তারা কেউ এলো না! বাবা কি এখনো মাকে রেগে বলেন; ‘ফকিরের বাচ্চা সে বড় কারবারি হইছে। ঘরে একমুঠো ভাত নেই আর সে গেছে দেশ ভাঙতে ।’ বাবা, তুমিও তো উনিশ’শ সাতচল্লিশে গিয়েছিলে বিশাল ভারত ভাঙার মিছিলে। সেদিন কি আরো ভাত ছিলো আমার দাদাজির ঘরে?
বাবা, তুমি যাদের সঙ্গ নিয়েছিলে শুধু ঈমানের শ্লোগানে জানতে কি তাদের হাতে জ্বলে ছাই হবে তুমি আর তোমার জীবনের সকল পাণ্ডুলিপি সাথে সাথে আমার মায়ের বস্তুনিতে মোড়া খোদার পাক কালাম ?
ভাবনায় ভাবনায় হাঁটি আমি দীর্ঘ পথ। দেখি, তছনছ হয়ে যাওয়া আমাদের সংসার রাজপথে মুখ থুবড়ে পড়ে-থাকা মায়া সবুজ নীলিমার বর্তুলদেহে রক্তাক্ত মানুষের ভালোবাসায় আকাশে উড়ে আমার চাঁদনী।


শোষণের আনলক দাঁত
জন্মান্ধ প্রজাপতি দেখে না লাইপাতাবনে পোকার বিস্তার
আধুনিক ইদুঁরের বোধবুদ্ধি
বিশ্বায়নের দেমাগ
শোষনের আনলক দাঁত
সে শুধু নতুন ফসলের মাঠে
উড়ে উড়ে দিয়ে যায় বাতাসের দেহে গিট্টু
ভাঙতে চেষ্টা করে ক্লাসিক ফর্মা
নাজিল করে প্রাচ্যের দেহে পাশ্চাত্যের জাঙার
আমাদের চিন্তার ক্ষেত পাকাল গেলে
চাষহীন মাঠে গজিয়ে ওঠে; আগাছা
আমলা-কামলা চিন্তাশূন্য রোবট মগজ
অতঃপর
ভিনদেশী নর্দমা থেকে ক্রমাগত আসে
বস্ত্রহীন নেংটা দেহদা
তাদের পাঠানো মাংসহীন হাড্ডি
মধ্যবিত্ত চিবিয়ে খাবার বিশ্বায়নী দাঁত
স্বার্থিক কচুপাতার থৈ থৈ স্বপ্নে
আমাদের তারাও পেয়েছেন গরিবের রক্ত-মাংসে কমলালেবুর স্বাদ
আমরা কেউ কেউ করে গেলাম যন্ত্রণার মাঠে বিক্ষুব্ধ সরিষার চাষ
কৃষকের ক্রমধারায়--------------এডোয়ার্ড ইকবাল বেনজামিন ছফা মজহার আর উত্তরাধুনিকতার মাঠে আমরা একঝাঁক তরুণ।



মায়া-মন
আঁতুর ঘরে চুমু খায় মা
ও আমার সোনার পুত-রে
কালো কাজলে
ছেলের কপালে
চাঁদের মতো এঁকে দেয় নজরটিকা
তবু আমার নজর লাগে
তোমার চোখের কালো গোলকে
প্রতিদিন, জ্বলে-পুড়ে ছাই হই
মায়া-মন।



হিটিপোকা
অনিদ্র আকাশে উড়ি আমি নিশিচোর পাখি
আবু ফীরের সবুজ বুকে পুরান সংসার খুঁজি ক্লান্তিতে করি নীল প্রার্থনা
বুকের ব্যথাগুলো ঝুলে কাঁদে সেমেটিক গাছের ডালে
ইয়াজুজ মাজুজের ছেলেরা হানা দিলো দ্রাবিড়ের দেশে
হিটিপোকা নেমে আসে
অন্ধকার ঝুলেছিলো তাদের দাঁতে
তারা আসে পিপিলিকার মতো ক্রমাগত
অন্ধকার ফেলে যায় আবিরের ঘরেনিশির বুকে নীরবে বাজে ঝিরঝির কদমের ব্যথা
হরপ্পার মাঠে লুকিয়ে কাঁদে কত পুরান দিনের কথা
গঙ্গা থেকে নীলনদে জলের পলি সহচরে আমাদের কুটুমিতা সবকিছু অন্ধ আজ
মৃত মানুষের বুকে খুঁজি নিজের আত্মা।


জালালি কৈতর
বরাক থেকে সুরমার তীরে বৈশাখি ঝড়ের মতো বেদনা নড়ে উঠলে অনেকগুলো বই বগলে নিয়ে শহরের গলিপথে উড়ে জালালি কৈতর। পচাশিপল্লা বাকলের ভাজে ভাজে কণা কণা দায়িত্বের বোঝা একদিন গাছের পাতায় মাদিমাকরের মতো আকড়ে ধরে প্রত্যয়ী বৃরে মনের পাঁজর। ফজর-যোহর-আসর-মাগরিব শেষে এশার জামাতে সে দেয় তাকবির ধ্বনি। রাখে মাওলার পায়ে মাথা। সমুদ্রের নোনাজলে তছনছ হয় আমাদের চিন্তা। অন্ধকার ভাঙে হাজার হাজার তাসবির দানা।


কর্নিথের রোদ
হাড়কাঁপা শীতভোরে
তুষারে সাদা হয় অন্ধকার শহরের বুক
মাটির ঘরে বন্দি আমি কালের ঘোড়া
কংকটের মতো উড়ি কালান্তরে
মানুষে লাশ মাড়িয়ে প্রজাপতির সোহাগ মূর্চায় বুনো আলেকজান্ডার
নৃপতি তুমি সরে দাঁড়াও
আমার সাথে করো না সূর্য্যরে আড়াল
কচুপাতার বাতাসে কেঁপে ওঠে বটগাছের আগা
শেকড়ে ক্ষয় হয় কালোজামের অহংকার
আমি একলা পাখি স্বপ্নিল চোখে নীরব হলে
আমার ডায়োজেনিস মনে থিতিয়ে পড়ে কর্নিথের রোদ
পৃথিবীর মানচিত্রে আমি ক্ষুদ্র পুরুপাখি ধীমান
বিলেতের আকাশে নাইওরি রাজহাঁস উড়ে
নিসর্গে বসন্তের গুণগুণ জয়গান
আমি আর আমি নয়
আমি শুকনো গাছের মরা ডালে জেগে-ওঠা কচিপাতা
ফুলের কলি
মানুষের ভালোবাসা আর একখণ্ড কবিতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন