রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

কবিতা আমার কাছে আত্মার অনুবাদ

কবিতা কি? এটা আমি কেমনে বুঝাই? এই প্রশ্নের উত্তরের চেষ্টাতো অনর্থক। তারপরও সবাই আতলামি করতে একটা উত্তর তৈরী করে। এই উত্তরটা হয় সবার নিজের মতো করে। আমি এই প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো করে একটা দিতে পারি। কবিতাকে আমি এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখেছি একেক সময় একেক রকম। সে কখনও হয়েছে আমার কাছে সখির ঘর। কখনো বেদনার সাগর। সে আমার একবুক ভালোবাসা কিংবা ঘৃণার পাহাড়। তার সাথে সুখ কিংবা দুঃখের মোলাকাত শেষে বিচ্ছেদের আগুন বুকে নিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছি, অথবা তার অপমান বা অপবাদের যন্ত্রনায় জ্বলে নগরের রাজ পথে হাটতে গিয়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছি, সে আমাকে অবিশ্বাসের চিক্কন দৃষ্টিতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে, আমি কাঙ্খিত গেইটে তালা ঝুলানো দেখে নীরবে চোখের জল ফেলে প্রত্যাবর্তন করছি, বলতে পারেন নীরবে-নিঃসঙ্গে কিংবা কোলাহলে শত সঙ্গের মেলায় বিচ্ছেদের আগুনে জ্বলছি, স্বাধীনতার একবুক জ্বালা নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার শপথ নিয়েছি, বাবার চোখ রাঙানো কিংবা মায়ের সোহাগে আমার উশৃংখল স্বপ্নের পৃথিবী তছনছ হয়ে যাচ্ছে, প্রাপ্তিতে আমি তৃপ্ত, সুখে মহাআনন্দ, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লিলার রসে ভাসন্ত ইত্যাদি সবই আমার কাছে কবিতা। আমি পথ চলছি কাঁধে লাশ নিয়ে কবরের পথে, এরই মধ্যে সখি উঁকি দিয়ে তার স্বর্গীয় চোখের ভাষায় একটা নীল গোলাপ দিয়ে গেলো কিংবা আমি লাশের উপর থেকে একটা তাজা ফুল চুরি করে সখির হাতে দিয়ে ভালোবাসার মুচকি হাসি দিলাম, এটা আমার কবিতা। আর কেউ যদি বলেন এটা পাপ, তবে আমি বলবো এটা পূণ্যের মহাকাব্য। মাঝেমধ্যে আমার ভালোবাসার ঘর ঘৃণার আগুনে জ্বলে মাটিতে মিশে যায়, আবার কখনও আহ্লাদের ফুলে বাসর সাজিয়ে সে আমায় ডাকে। এমন একটি রাতের কথা আমার স্মরণ হচ্ছে, যে রাতের প্রথম প্রহরে প্রেমের কুঞ্জে আমার খুশির মেলা আর শেষ প্রহরে হয় সংঘাত। সে শপথ করে বলে আর কোনদিন কথা বলবে না। এই শপথের মুখে কালবৈশাখি ঝড় হয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে গভীর রাতে দীর্ঘ পায়ে হেটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি নিজে হয়ে যাই বেদনার এক মহাকাব্য। আবার যে আনন্দের রাতে আমাকে নিরানন্দ করে সে আমার শহর থেকে দূরে চলে গেলো। সেই রাতে আমি যোগী হয়ে তাকে খুঁজলাম। এই খুঁজাটা যেমন একটি কবিতা, তেমনি আবার যখন তাকে শহর থেকে দূরের কোথাও পেয়ে সকল লজ্জা ভেঙে দু'জন পুকুর পারে লিচু গাছের নীচে পূর্ণিমার মুখোমুখি মিলিত হলাম তখন পূর্ণিমা, পুকুর পার, লিচু গাছের নীচ সবই হয়ে যায় একেকটি কবিতা কিংবা আমরা দু’জন হই কাল-মহাকালে মহাকাব্য। একের লিলা একের খেলায় তার আত্মায় যখন আমার আত্মা, তখন সে একখণ্ড কাগজে লিখে দিলো-আমি তোমাকে পছন্দ করি না। বেকার হয় আমার সব সাধনা। বেদনার ঝলক আসে মনে। এই ঝলকটা আমার কবিতা। কবি ইমরাউল কয়েস কিংবা জয়দেব মতো আমি স্পষ্ট দেখি তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে ঝুলে থাকে অসংখ্য কবিতার ছন্দ, শিল্প, নান্দনিকতা। কেউ যদি তাতে আমার নিন্দা করে তবে আমি প্রশ্ন করবো-কৃষ্ণ করলে লিলা খেলা আর আমি করলে কেন দোষ? জানো, আমার খুব হাসি পায় যখন তোমরা শুধু শুধু কালের কবিদের নিন্দা করো অথচ কিছুই বলতে সাহস করো না মহাকালে। অথচ তারা অনেকে আজীবন শুধু দেহের অঙ্গগুলোর রূপ-রঙ আর কার্যকারিতার বর্ণনা দিয়ে গেলেন। বরং উল্টো তোমরা তাদের প্রশংসায় বলো_ওরাতো আজও অমর হয়ে আছেন তাদের মহান সৃষ্টিতে। তোমাদের এই বৈষম্যটাও আমার কাছে মনে হয় একটি কবিতা। পূর্ণিমার নিঃসঙ্গ সময় বাঁশঝারের নিচে বসে সবুজ পাতাগুলোর হেলন-দোলন দেখছি, হঠাৎ দেখি প্রিয়ার ঠোঁট ঝাপটে ধরে সবুজ বাঁশপাতায়, কেমন যেনো জোনাকী পোঁকা জ্বলে উঠে মনে, এই জোনাকী পোঁকার আলো আমার কবিতা। প্রিয়ার মেহদী রাঙা হাতের আঙ্গুলগুলোর দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ মনে হচ্ছে এগুলো আঙ্গুল নয় যেনো কাশ্মিরী আঙ্গুর কিংবা সে শাহাদত আঙ্গুলে পানে চুন ঘষে কিলি বানিয়ে দিয়ে তার আঙ্গুলের চুন আঙ্গুলে দিলে আমি ভাবের ঘরে কেজু হয়ে নিজেই হয়ে যাই একটি কবিতা। অথবা বলতে পারেন এখানের প্রতিটি মূহুর্ত আমার কাছে একেকটি মুক্তাঝরা কবিতা।মোটকথা, কবিতা আমার কাছে হৃদয়ের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের নিরব ঝলক। কবিতাকে যারা বলেছেন, `পাঠকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম', আমি সেই গুরুদের সাথে দ্বিমত করবো না। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, সব পাঠকের ক্ষেত্রে এই যোগাযোগটা নাও হতে পারে। কথাটা বলতে হবে আরেকটু নির্দিষ্ট করে। কবিতার মাধ্যমে যোগাযোগ সেই পাঠকের সাথে সম্ভব যাদের কাব্যজ্ঞান এবং প্রেমজ্ঞান আছে। কবিতা বুঝার বিষয় নয়, এটা অনুভবের বিষয়। এই অনুভবের জন্য সজীব আত্মা চাই। শুধু ভাষায় মাষ্টার কিংবা অধ্যাপক হলেই কবিতা বুঝা হয় না। অধ্যাপক আর মাষ্টারগণ কবিতার বিচার করেন দৈহিক। তারা শব্দ আর ভাষাকে গুরুত্ব দেন বেশি। কবিতার জন্য শব্দ আর ভাষার গুরুত্ব আমি অস্বীকার করছি না। তবে শুধু শব্দ আর ভাষার নাম কবিতা নয়। কবিতা হলো জাগ্রত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলে অন্ধকারের ভেতর যে আলোটুকু ঝলমল করে, তা। সবার পক্ষে এই আলোকে দেখা এবং ধারণ করা সম্ভব হয় না। তাই সবাই কবি হয়ে উঠে না। এখানে অবশ্য ভাষা এবং শব্দের প্রয়োজন হয়। ভাষা এবং শব্দকে আমি কবিতার বাহন মনে করি। আত্মার বাহন যেমন দেহ। যে দেহে আত্মা নেই আমরা তাকে মৃত বলি। তাকে কবরে কিংবা শ্মশানে নিয়ে এই গ্রহ থেকে চির বিদায় জানাই। আমি মনে করি, ভাষা এবং শব্দ প্রয়োজন হয় কবিতার জন্য, কবি হওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য কবি আমি দেখাতে পারবো যারা তাদের ভাবকে ভাষা এবং শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, ভাষা এবং শব্দ থেকে তাদের ভাবের ওজন বেশি হয়ে গিয়েছিলো। অনেক সময় আমাদের নিজের অবস্থাও এমন হয় যে, ভাবের ঘরে কেজু হয়ে যাই। মনের ওজন থেকে দেহের ওজন কমে গিয়ে হাওয়ায় উড়ে ক্রমাগত। পারি না আর কোন কাজে মনোযোগি হতে। অনেকে শরীর খারাপ মনে করে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিয়ে যান, আমি এই পরামর্শদাতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের স্বর্গে বসে হাসি। সব কবিদেরই নিজের ভেতর একটা স্বর্গ আছে বলে আমার বিশ্বাস। এই স্বর্গে তারা সুখেÑদুখে লুকিয়ে থাকেন। তাই আমি বলি কবিতা প্রকাশের জন্য ভাষা ও শব্দের জ্ঞান খুবই জরুরী, কিন্তু কবি কিংবা কবিতার জন্য এগুলোর কোন প্রয়োজন হয় না। আমার কাছে একজন জীবন্ত বোবা মানুষকে মনে হয় একটা মহাকাব্য। যিনি মৃত তিনি যত বড় কিছুই হোন না কেনো তার সাথে এই গ্রহের কোন কারবার নেই। তার সৃষ্টিতে যদি জীবন থাকে তবে সেটা প্রয়োজন হবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষন জীবন্ত মানুষের। তাই জীবনটাই আমার কাছে একটা কবিতা। যাদের আত্মায় আত্মা নেই তারা কবি কিংবা কবিতাকে বুঝার কথা নয়। কবিতাকে আমি যে চোখে দেখি, আপনি বা অন্যজন সে চোখে না দেখতে পারেন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং আমি বলবো, এই ভিন্নতার জন্যই একেক জনের কবিতা একেক রকম স্বাদ নিয়ে আসে। আবার কবিতার ব্যাখ্যা পরিবর্তন হয় স্থান, কাল, পাত্র বিশেষ। আমরা অনেক সময় কারো কবিতা একবার কিংবা দু’বার পাঠ করেই মন্তব্য করে বসি তা হয়নি। কেউ কেউ আবার কেনো হয়নি তাও না বলে শুধু আতলামি করেন। স্মরণ রাখতে হবে প্রকৃত কবিরা কিন্তু আতলামিতে নেই। আতলামি করে বেশি অকবিরা। একজনের কবিতা আমার হৃদয় স্পর্শ না করলে যে তা হয়নি বা ভালো কবিতা হয়ে উঠেনি, সেই দাবী কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত অনেক বড় বড় কবিরও করার সাহস ছিলো না। কিন্তু আমাদের বন্ধুদের অনেককে এই মূর্খতায় আমি প্রায়ই দেখি। আমি মনে করি, কবিতা ভালো লাগা কিংবা না লাগা অনেক সময় ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে। তা ছাড়া কবি-সাহিত্যিকদের কাছে কবিতার যে ব্যাখ্যা হয় তা অনেক সময় সাহিত্যের মাষ্টার কিংবা অধ্যাপকদের কাছে না হতে পারে। কবিতায় চমক লাগাটাও অনেক সময় ব্যক্তির স্মৃতি কিংবা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। কবিতায় ম্যাসেজ থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। কবিতার ম্যাসেজ কিংবা উপমা ব্যক্তির বিশ্বাসের উপর ভালো লাগতে পারে, নাও লাগতে পারে। কবিতা নিয়ে একেক জনের একেক বক্তব্য থাকতেই পারে। এ ব্যাপরে আমি সবার বক্তব্য আগ্রহ নিয়ে শোনলেও বিবেচনায় রাখি নিজের অভিজ্ঞতাটা। কেউ যখন আমায় কবিতা লিখতে কিংবা না লিখতে বলেন, আমি তাকে পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে রাখতে পারবো না বলে দুঃখ প্রকাশ করি। কারন, আমি মনে করি আমার কবিতা একান্ত আমার কিংবা যে আমায় ভালোবাসে শুধু তার। যে কেউ আমার কবিতার খারাপ ভালো বলার অধিকার রাখেন, কিন্তু কোনটা আমি লিখবো আর কোনটা লিখবো না, তা বলার অধিকার আমি কাউকে দেইনি। কারন, আমার জীবনে আমি সব কিছু মানুষের সুখের জন্য করলেও শিল্প-সাহিত্য করি আমার আত্মার সুখের জন্য। আমার আত্মা যদি চিত্র এঁকে আনন্দ পায় আমি চিত্র আঁকি। গল্প লিখে আনন্দ পায়, আমি গল্প লিখি। আমি স্বীকার করি প্রবন্ধে আমার কর্ম বেশি, তবে তাও আমি আনন্দ অনুভব করলে লিখি, গানে আনন্দ পেলে আমি গান লিখি। আর যখন কবিতায় মন যায় তখন লিখি কবিতা। পৃথিবীর কারো সংজ্ঞায় আমার কবিতা না হলেও যদি আমার আত্মা খুশি হয় আমি আজীবন লিখে যাবো। কারো নিন্দা কিংবা প্রশংসায় আমার কোন ক্ষতি কিংবা লাভ হয়না। আমি নিজে এক্ষেত্রে স্বাধীন মানুষ। আমি অন্যের স্বাধীনতার বিশ্বাস করি। যে কেউ আমাকে কিংবা আমার কর্মকে অপছন্দ করতে পারেন। আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন। যুক্তিসম্মত ত্র“টিগুলো আলোচনায় এনে পরামর্শ দিতে পারেন। এটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকারের ভেতর আসে। আমি সবার পরামর্শ পাঠ করবো, যুক্তিসম্মতগুলো রাখতে চেষ্টা করবো। আমার সামনে কেউ কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনান্দ হয়ে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাদের কেউ হওয়ার জন্য শিল্প-সাহিত্য করি না। আমার প্রতিযোগিতা শুধু আমার সাথে। আমার শত্র“ কিংবা মিত্র আমি নিজে। গোটা পৃথিবী যদি আমায় অপমান করে আর আমার আত্মা এই অপমানে আনন্দিত হয়, তবে আমি প্রার্থনা করি সেই অপমানের জন্য। মূলত এটাই আমার কাছে কবিতা। আবার আমি যখন বললাম, একটি কবিতা যদি একজন পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে তবে মনে করি আমি উত্তীর্ণ। আমি আরেকটু এগিয়ে বলতে চাই, আমার কবিতা যদি কমপক্ষে আমার প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার মনে আনন্দ দিতে পারে তবে তা সফল। আমিতো মনে করি আমার জানাজাতেও সে এসে কষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই যে আমায় ভালোবাসে না। কেউ বলতে পারেন, `ব্যক্তিবিশেষ ভালো লাগা কবিতার মানদণ্ড তো হতে পারে না। কবিতার মানদণ্ড হবে কাব্য গুন।' আমি উত্তরে বলতে চাইÑকাব্যগুণের সংজ্ঞা কি? ব্যক্তি ছাড়া কি কিছুর অস্তিত্ব আছে? আপনি যিনি আমার কবিতাকে কাব্যগুনের বিচার-বিবেচনা করবেন তিনি কি ব্যক্তির উর্ধ্বে? আমি আরেকটু শক্ত করে বলতে চাই এখানে, ব্যক্তির বাইরে ঈশ্বর কিংবা আল্লাহও নেই। ইমাম গাজ্জালী বলেছেন ` মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু', নিজের সাথে পরিচিত হলেই রব অর্থাৎ আল্লার সাথে পরিচিত হওয়া যায়। সর্বদর্শনের ভাষায় বলতে গেলে আমি আছি বলে তুমি বা তোমরা আছো। তাই কবিতাকে আমি এবং আমরা'র পর তুমি এবং তোমরা'র মতো করে দেখি। কবিতার কাব্যগুণের নির্দিষ্ট কোন ফর্মূলা আজও কেউ দিতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। আমরা যে সব ফর্মূলা দেখতে পাই এগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিক কিংবা বক্তব্য। গদ্য, ছড়া, পদ্য, গীতি ইত্যাদি কবিতার মধ্যে বিভিন্ন আঙ্গিক তৈরি করে এক থেকে অন্য কবি পৃথক হতে চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হননি। কবিতায় কেউ কেউ নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে পৃথক হতে চেষ্টাও করেছেন। নতুনত্ব আনতে গিয়ে অনেক সময় এই কবি অন্যান্য কবিদের দ্বারা হয়েছেন নির্যাতিত কিংবা তিনি করেছেন অন্যদেরকে নির্যাতন। এক্ষেত্রে আমরা মির্জা গালিবের কথা বলতে পারি উদাহরন স্বরূপ। মির্জা গালিবকে তাঁর সময়ের প্রতিষ্ঠিত কবিদের মাহফিল থেকে ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবে বের করে দেওয়া হতো এবং বলা হতো মির্জার কবিতা হয় না, তাঁর কোন কাব্যজ্ঞান নেই। সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন লিখেছেন, কবি নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা তিনি হয়নি বলে ডাস্টবিনে ফেলে দিতেন, যার বেশির ভাগ-ই পরবর্তিতে খ্যাতি লাভ করেছে। জীবনান্দ দাশ তো তাঁর সময়ের সবচাইতে অনালোচিত কবি। এভাবে আরো অসংখ্য কবির ইতিহাস বর্ণনা করা যাবে। আমি কাব্যগুণের কথা অস্বীকার করছি না। তবে এই কাব্যগুণ জিনিষটা মূলত কি? তা নির্ধারণ করতে হলে আমি মনে করি কান আর মনকে কাজে লাগাতে হবে। কান আর মন যদি কোন কবিতাকে উত্তির্ণ করে দেয়, আমার বিশ্বাস এটাই কাব্যগুণ। আর এই বিষয়টা কোন মাষ্টার বা অধ্যাপকের গবেষনার বিষয় নয়, এটা পাঠক, লেখক আর শ্রোতার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। অনেক সময় অনেককে বলতে শোনি, আপনার কবিতায় ভাবের অভাব রয়েছে। আমি বিষয়টাকে ব্যক্তিগত মনে করি। কারন, একটি কবিতায় একজনের ভাব না আসলেও আরেকজনের ভাব আসতে পারে। আবার দেখা গেলো, একই কবিতা বিভিন্ন সময় পাঠকালে ভাবের পরিবর্তন হয়। কবিতায় ভাব আর কবিতার ভাব এখানে দু’টা পৃথক বিষয়। কবিতায় কবি যে ভাব দিয়েছেন তা পাঠক পাওয়ার কথা নয়। কবিতার ভাবকে পাঠক ধরতে চেষ্টা করতে পারেন। এই ধরাটাও সবার নিজস্ব স্মৃতি, অভিজ্ঞতা কিংবা পঠন-পাঠনের উপর নির্ভর করে। কবিতা কোন ক্লাস করে শিখা যায় না। কবিতা অনেকটা পিরাকির মতো আধ্যাত্মিক ব্যাপার। এখানে সাধন-ভজন খুবই জরুরী বিষয়।আমাকে কেউ কেউ জিগ্যাস করেন-কবিতায় ভাব না ভাষার গুরুত্ব বেশি? এমন প্রশ্ন যারা করেন আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। আমি বলি এই প্রশ্নে বিজ্ঞদের মাঝে বিতর্ক হতে পারে। আমি কিন্তু এবিষয়ে বিজ্ঞ নই। আমি প্রায় দেখি এখানে কেউ বলেন ভাবের গুরুত্ব, কেউ বলেন ভাষার, আবার কেউ দু'টোর কথা-ই বলে থাকেন। এই বিতর্কটা মূলত প্রকট হয়েছে জর্মানে হেগেল এবং ইয়ং হেগেলিয়ানদের বিতর্ক থেকে, এই বিতর্কটা আমাদের ঘরে নিয়ে এসেছেন বস্তুবাদী মাকর্সবাদীরা। এই বিতর্কের এক পর্যায়ে যখন প্রশ্ন দেখা দিলো দু’টার একটাকে অগ্রাধিকার দিতে হলে তবে কোনটাকে আমরা গ্রহণ করবো আগে? আমাদের ভাববাদীরা বললেন, প্রথমে ভাব, অতপর ভাষা। কারণ, ভাব না হলে ভাষার জন্মই হতো না। তখন বস্তুবাদীরা বলেন-ভাব হলো মূর্খতা। ভাষাই হলো আসল। আবার ভাষাবিদরা এসে বলেন.`ভাবতো সবারই থাকে, কিন্তু সবাইতো আর লেখক হতে পারে না। আর ভাষা না হলে লেখবে কি দিয়ে, তাই ভাষার গুরুত্ব প্রথমে। ভাববাদীরা তখন এসে বলে, না আপনাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। পৃথিবীতে অনেক মানুষইতো ভাষা জ্ঞানী আছেন, যেমন আমাদের ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমূখ, কিন্তু তারা কবি হিসেবে উত্তির্ণ হতে পারেন নি। আমি এই জায়গায় এসে বলি-তোমরা এই বিতর্ক করে পন্ডিত হও যত পারো। আমরা তোমাদের বিতর্ক দেখে হাসি, অতপর কবিতা লেখি। কারণ, তোমরা পন্ডিত, মাষ্টার, অধ্যাপক আর আমরা কবি। কবিদের কাছে ভাব হলো কবিতার আত্মা আর ভাষা হলো দেহ। কবি আধ্যাত্মিক না হলে তার কবিতায় আত্মা থাকে না। আধ্যাত্মিক হওয়ার জন্য ধর্ম-বর্ণ কোন আলোচ্য বিষয় নয়। এটা আত্মাকেন্দ্রিক সাধনার বিষয়। আমার মার্কসবাদী বন্ধুরা বলেন, কার্ল মার্কস আধ্যাত্মিক ছিলেন না! আমি বলি এসব মিথ্যে কথা। তিনি যদি আধ্যাত্মিক মানুষ না হতেন তবে `ডাস ক্যাপিটেলিজম' কিংবা `জর্মান ভাবাদর্শ' গ্রন্থদ্বয় সৃষ্টি করতে পারতেন না। কার্ল মার্কস কিন্তু কবি নয়, তবু অপ্রাসঙ্গিক নয় এই আলোচনায়। কারণ, এখানে ভাববাদ আর বস্তুবাদের সংঘাতটা প্রকট করেছেন মার্কসবাদীরা কার্ল মার্কসের অজুহাত দিয়ে। আসলে অন্যের আত্মা কিংবা কবিতার আত্মা দেখার জন্য নিজের ভেতরে আত্মা থাকতে হয়। মার্কসবাদীদের আত্মা ছিলো না বলে তারা কার্ল মার্কসের আত্মা দেখতে পারেননি। আমি মনে করি যাদের আত্মায় আত্মা নেই তাদের সৃষ্টিতেও আত্মা থাকার কথা নয়। আত্মাহীনরা কিছু শব্দের জন্ম দিতে পারেন কিন্তু কবি হতে পারেন না। আবার একথাও সত্য যে, কবিতার দৈহিক কাঠামোকে সুঠাম করার জন্য ভাষা জ্ঞান আবশ্যক। ভাষাজ্ঞান না থাকলে কবি হওয়া যায় কিন্তু কবিতার জন্ম দেওয়া যায় না। সুতরাং ভাব এবং ভাষা দুটোর সমন্বয়ই আমার কবিতা। কবিতা আমার কাছে আত্মার অনুবাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন