বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০১০

কুরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?

কুরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?

সৈয়দ মবনু

প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ২০০০

দ্বিতীয় প্রকাশ : ডিসেম্বর, ২০০৮

প্রকাশক : নগর সাহিত্য ও প্রকাশনা সংস্থা

বারুতখানা, সিলেট।

মূল্য : ৪০ টাকা।

----------------------------------------------
ভূমিকা

ইসলামি জ্ঞান চর্চা হ্রাসের পাশাপাশি আমাদের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুসলিম পরিবার ও সমাজে দিন দিন লক্ষ্যণীয়ভাবে বিভিন্ন প্রকার বেদআত, কুসংস্কার, ইসলামের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানে অত্যন্ত জঘন্য আকার ধারণ করেছে ঝাড়-ফুক ও তাবিজাত। অনেক ক্ষেত্রে তাবিজাতের নামে যাদু চলছে। যারা যাদু শিখে, যারা যাদু করে এবং যারা যাদু করায় ওরা সবাই যে কাফের সে ব্যাপারে কারো দ্বি-মত নেই। কিন্তু তাবিজাত নিয়ে এখনো মুসলিম সমাজে প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। এর প্রধান কারণ, এক শ্রেণীর মুসলমান ইসলামি পোশাক গায়ে দিয়ে ইসলামি চিকিৎসা পদ্ধতি বলে তাবিজাত করছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজাতের মহত্ত্ব বর্ণনা করে নকশে সোলেমানি, তাবিজাতে রুহুল্লাহ, মোহাম্মদী খাবনামা ইত্যাদি প্রচুর বই ইতোমধ্যে এক শ্রেণীর তাবিজ ব্যবসায়ীরা লিখে বাজারে বিক্রি করছেন। এই সমস্ত বই-এ তাবিজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে এমনভাবে কিছু কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যা পাঠ করলে ইসলাম সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞানী মুসলিম সমাজ বিশেষ করে মহিলা শ্রেণী বিভ্রান্ত হওয়ারই কথা-আর তা হচ্ছেনও। তাবিজ সম্পর্কে ইসলামের রায় কী? তা আমরা অনেকেই জানি না। বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় এ সম্পর্কে বিভিন্ন বই প্রকাশিত হলেও আমাদের বাংলাদেশী আলেম সমাজ রহস্যজনকভাবে নিরবতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার এ সবের সাথে জড়িতও আছেন। অনেকে আবার এটাকে ব্যবসা হিসেবেও গ্রহণ করে নিয়েছেন। তবে হক্বানী আলেম সমাজ নিরবতা প্রদর্শন করলেও এসব থেকে পরহেজ করছেন বলে আমাদের ধারণা। পারিবারিকভাবে আমরা এ সবের প্রতি কোনদিনই আকৃষ্ট নই। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে আমাদের যে পরিবার তাতে আমরা সবাই ধর্মের ব্যাপারে আপোষহীন, গোটা সমাজের অধিকাংশ মুসলমান যেখানে তাবিজাতকে ধর্মের অংশ মনে করছে সেখানে আমরা কেন আকৃষ্ট হতে পারছি না? এই প্রশ্ন এক সময় জাগ্রত হলো বিবেকে। তাই কুরআন-হাদিসে খুঁজতে লাগলাম তাবিজাতের ভিত্তি। খুঁজতে গিয়ে যা পেয়েছি তা বাঙালি পাঠকদের সামনে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে এই লেখা।সম্মানিত পাঠক, এটা কোন ফতোয়া নয় তবে চিন্তার খোরাক। আপনি পড়ুন, পর্যালোচনা করুন, খুঁজে দেখুন সত্য-মিথ্যার অধ্যায়গুলো। এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।তাবিজাত কী?আরবি ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, ‘তামীমা’....শব্দ থেকে এসেছে তাবিজ। আবার অনেকে বলেছেন ‘তামীম ’...শব্দ থেকে। বাস্তবে এই দু’শব্দের অর্থ এক। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-হেফাজত, পৃষ্ঠপোষক, রক্ষণ করা বা Protection. (তথ্য: ‘লেসান’ নামী অভিধানও ফিরুজুল লোগাত)।বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক হযরত ইবনে জোনাই (রা.) বলেছেন, ‘তামীমা’ (তাবিজ) হচ্ছে ঐ জিনিস যা তাগায় বেঁধে লটকানো হয়। বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা ইবনে হাজর (রা.) বলেছেন, ‘তামীমা হচ্ছে তাবিজ বা হাড় যা মাথায় লটকানো হয়। ইসলামপূর্ব জাহেল যুগের মানুষের বিশ্বাস ছিলো যে, তাবিজ দ্বারা মানুষের বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়। আল্লামা ইমাম ইবনুল আসীর (রা.) বলেছেন, ‘জাহেল যুগের আরবগণ শিশুদের গলায় তামীমা অর্থাৎ তাবিজ লটকাতো যাতে বদনজর না লাগে। এটা তাদের বিশ্বাস ছিলো, অতঃপর ইসলাম তাদের এই বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। (তথ্য: আকিদার মানদণ্ডে তাবিজাত, আল্লামা আলী বিন নাফায়ী আল্ উলাইয়ানী)মানুষ তাবিজ কেন ব্যবহার করে?তাবিজ ব্যবহারের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষ সাধারণত তিনটি উদ্দেশ্যে তাবিজ ব্যবহার করে থাকে।এক. ঐ সমস্ত রোগ, বদনজর ও বিপদাপদ থেকে রা পাওয়ার আশায় যা এখনো সংগঠিত হয়নি।দুই. বিপদ এসে গেলে তা থেকে মুক্তি লাভের আশায়।তিন. কোন অসৎ কিংবা সৎ উদ্দেশ্যে হাসিলের আশায়।অতীত ও বর্তমানে ব্যবহৃত তাবিজাতঅতীত ও বর্তমানে ব্যবহৃত তাবিজগুলো বেশ কয়েক প্রকার রয়েছে। যেমন:

১. আননাফরা

এটা এই প্রকারের তাবিজ যা জ্বীন ও মানুষের বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিশুদের হাত, পা, কিংবা গলায় বেঁধে দেয়া হয়। আবার কখনো অপবিত্র জিনিস দিয়ে এই তাবিজ অতীতেও লেখা হতো এবং বর্তমানেও হয়ে থাকে। যেমন-ঋতুস্রাবের নেকড়া, হাড় এবং কালো মুরগীর রক্ত ইত্যাদি। অথচ অপবিত্র জিনিস দিয়ে কুরআন স্পর্শ করা সম্পূর্ণ হারাম।

২. আকরা, যা মহিলাদের বাচ্চা না হলে কোমরে বাঁধার জন্য দেয়া হয়।

৩. ইয়ান জালিব, যা দেয়া হয় স্বামী রাগ করলে কিংবা কোথাও রাগ করে চলে গেলে তাকে স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং ফিরিয়ে আনতে।

৪. তিওয়ালা

৫. কারজাহলা

৬. দারদাবীস

৭. কাহলা

৮. কারার

৯. হামরা

চার নম্বার থেকে নয় নম্বার পর্যন্ত যে তাবিজাতের নাম বলা হলো এগুলো হচ্ছে-ফুর্তিজাতীয় তাবিজ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহৃত হয়। ‘কারার’ এবং ‘হামরা’ তাবিজে নির্দিষ্ট একটি মন্ত্র লেখা হয়, যা শিরক পর্যায়ের। যেমন বলা হয় : ‘ইয়া কারারু কারিহি, ইয়া হুমারাতি ইহমারিহি, উন উকবালা ফাসারিয়াতি ওয়া উন আদবাবা ফাদাবিহি মিন ফারজিহি ইলা ফি-হী।’ এ মন্ত্রে আল্লাহর ‘রাবুবিয়্যাত’ ও ‘ইলাহিয়াতের’ সাথে শিরক করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে শিরক থেকে রা করুন।

১০. খাছম্, যা রাজা-বাদশা বা বিচারকের সামনে যাওয়ার সময় মামলায় জিতার জন্য আংটির নিচে, জামার বোতামে অথবা অস্ত্রের কভারে লটকানো হয়।

১১. আত্ফ, মানুষের দয়া-মায়া পাওয়ার আশায় ব্যবহার করা হয়।

১২. সালওয়ানা। সাদা ফুর্তিজাতীয় বস্তু দ্বারা তৈরি তাবিজ। বালুতে পুঁতে রাখলে কাল হয়ে যায়। অতঃপর সেখান থেকে উঠিয়ে ধৌত করে অস্থির মানুষকে পানি পান করানো হয় শান্তি ফিরে পাওয়ার আশায়।

১৩. কাবলা, বদনজর থেকে বাঁচার জন্য সাদা পুঁতি দিয়ে তৈরি এ তাবিজ ঘোড়ার গলায় বেঁধে দেয়া হয়।

১৪. অদাআ, এটা পাথরের তাবিজ, বদনজর থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে তা সমুদ্রে নিপে করা হয়।

১৫. তাহবীতা, যা লাল ও সাদা রংয়ের তাগার ছিগা তুলে মহিলাদের কোমরে বাঁধা হয় যাতে বদনজর না লাগে।

১৬. এক প্রকারের তাবিজ আছে যা যাদু ও বদনজর থেকে বাঁচার জন্য খরগোশের হাঁড় ব্যবহার করা হয়।

এছাড়াও আরো বহু প্রকারের তাবিজ আছে, ইসলাম পূর্বযুগে এ সব তাবিজ জাহিলেরা যেভাবে ব্যবহার করতো আজ তের-চৌদ্দশত বছর পরও মুসলিম সমাজে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে লণীয়ভাবে। ইতিমধ্যে অনেকে এই তাবিজাতকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করে নিয়েছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই সমস্ত তাবিজ ব্যবসায়ীদের বিরাট-বিরাট বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। অনেকে আবার বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে জ্বীন সাধনার কথা উল্লেখ করেন। কেউ কেউ আবার স্বপ্নে পাওয়া হাবি-জাবির কথা বলে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চান। হুজুর সায়দাবাদী, দেওয়ানবাগী, দায়রা শরিফ ইত্যাদি তাবিজ ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপন পড়লে কে-না আকৃষ্ট হয়।তাবিজাত এক প্রকারের শিরক নয় কি?আমরা যারা রোগমুক্তি, বদনজর ও বিপদ-আপদ থেকে রা পাওয়ার জন্য কিংবা কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাবিজ ব্যবহার করে থাকি তাদের স্মরণ রাখা উচিৎ যে সকল কারণে তাবিজ ব্যবহার করা হয় এর একটিও পূর্ণ করার শক্তি না আছে তাবিজের, না তাবিজ লেখেকের। যদি কেউ তাবিজ কিংবা তাবিজ লেখকের শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করেন তাহলে তার ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে-‘তোমরা আল্লাহর উপর ভরসা কর, যদি মুমিন হয়ে থাক।’ (সুরা: মায়েদা-২৩)এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে, আল্লাহ ছাড়া কোন কিছুর উপর ভরসা করলে ঈমানদার হওয়া যায় না।‘আল্লাহ তোমাদেরকে কেশ দান করলে তিনি ছাড়া মোচনকারী কেউ নেই।] (সুরা: আন্-আম-১৭)‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহে বিশ্বাস করে কিন্তু আবার তার সাথে শরীক করে।’ (সুরা: ইউসুফ-১০৬)এ রকম আরো অসংখ্য আয়াত রয়েছে, যা পড়লে স্পষ্ট বুঝা যায় তাবিজের উপর বিশ্বাস বা ভরসা করা শিরক। অনেকে বলেন-বিশ্বাস তো আল্লাহর উপর আছে কিন্তু তাবিজ হচ্ছে একটা উসিলা বা মাধ্যম। মুসলমানদের বুঝা উচিৎ আমরা এমন শক্তিধর আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি, যিনি মাধ্যম ছাড়া সকল সৃষ্টির মঙ্গল-অমঙ্গল করতে পারেন।তাবিজাত যে র্শিক সে সম্পর্কে হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসীর (রা.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত এবং সর্বজন স্বীকৃত ‘তাফসীর-এ-ইবনে কাসীর’-এ সুরা ইউসুফের ১০৬ নম্বার আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘এ কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, কতকগুলি শির খুবই হালকা এবং গোপনীয় হয়। স্বয়ং শিরককরীও তা বুঝতে পারে না। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত হুযাইফা (রা.) একজন রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে যান। সেই ব্যক্তির হাতে একটি সুতা (যাকে তাগা বলা হয়) বাঁধা ছিলো। তিনি ওটা ছিড়ে ফেলে বললেন, ‘মুমিন হয়েও শিরক করছো?’ (তাফসিরে ইবনে কাসীর)।আল্লামা ইবনে কাসীর (রা.), হযরত হুযাইফা (রা.) থেকে যে কথা বর্ণনা করেছেন তা অবশ্যই হুযাইফা (রা.)-এর মনগড়া ছিলো না। রাসুল (সা.)-এর সাহাবিগণ (রা.) ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে মনগড়া কথা বলতেন না, বরং রাসুল (সা.) যা বলতেন তা তারা প্রচার করে গেছেন।তাবিজাত সম্পর্কে হাদিসে রাসুল (সা.)-এর ভাষ্যইসলামের ভিত্তি কোন ব্যক্তি কিংবা জাতি নয়। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও হাদিস। আজকে মুসলিম সমাজে যারা ইসলামি পোশাক গায়ে দিয়ে তাবিজ ব্যবসা করছেন এবং তাবিজাতকে বৈধ করতে বিভিন্ন প্রকার যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন তাদের বক্তব্যকে আমাদের বুঝতে হবে, ইসলামি বিধান অনুসারে পর্যবেণ করতে হবে। কোন জিনিস বা কর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কিনা, তা পর্যবেণ করতে হলে প্রথমে তা সরাসরি কুরআনে খুঁজতে হবে। যদি কুরআনে না পাওয়া যায় তাহলে হাদিসে। যদি হাদিসেও স্পষ্ট পাওয়া না যায় তাহলে সাহাবায়ে কেরামদের জীবনীতে। যদি এখানেও স্পষ্ট না পাওয়া যায় তাহলে কিয়াসের যোগ্যতাসম্পন্ন উলামায়ে কেরাম কুরআন, হাদিস এবং সাহাবাদের জীবনকে সামনে রেখে মতামত দিবেন। তাবিজাত সম্পর্কে জানতে আমাদের এতটুকু যেতে হচ্ছে না। কুরআনে এ সম্পর্কে ইশারা এবং হাদিসে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে, শুধু অভাব আমাদের জানার। আমরা এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারবো তাবিজাত কতটুকু ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। পাঠকের সুবিধার্থে নিম্নে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো-১. বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী হযরত যয়নাব (রা.) বলেন, ‘আমার স্বামী হযরত আব্দুল্লাহ বাহির থেকে বাড়িতে প্রবেশ করতে গলা খাঁকড়াতেন এবং থু থু ফেলতেন। কারণ যাতে বাড়ির লোকেরা তাঁর আগমনের সংবাদ পায় এবং তাদেরকে তিনি এমন অবস্থায় না দেখেন যা তাঁর অপছন্দনীয়।’ এটা তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস ছিলো। অভ্যাস অনুযায়ী একদিন তিনি এমনভাবে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। এই সময় আমার কাছে এক বুড়ি ছিলো, সে আমার রোগের জন্য ঝাড়-ফুঁক দদিতেএসেছিলো। আব্দুল্লাহ্ (রা.)-এর গলার আওয়াজ শোনে আমি বুড়িকে চৌকির নিচে লুকিয়ে দেই। তিনি ঘরে এসে আমার পাশে চৌকির উপর বসেন এবং আমার গলায় তাগা দেখে জিজ্ঞেস করেন এটা কী? উত্তরে বললাম এটা আমি ঝাড়-ফুঁক করিয়ে গলায় বেঁধেছি। সাথে সাথে তিনি তা ছিড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন-‘আব্দুল্লাহ্ ঘর শিরকের অমুখাপেক্ষি স্বয়ং আমি রাসুল (সা.)কে বলতে শোনেছি যে-` ঝাড়-ফুঁক, তাবিজাবলী এবং ডোরা-সুতা বাঁধা শিরক। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, হাকেম, ইবনে মাজা)২. হযরত ইমরান বিন হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস-অর্থ: একদিন রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির হাতে তামার চুড়ি দেখতে পেয়ে বললেন, এটা কী? সে বললো-এটা ওয়াহেনার অংশ (ওয়াহেনা হচ্ছে এক প্রকারের হাড় যা কেটে ছোট ছোট করে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়)। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেল। কারণ, এটা তোমার দুর্বলতাকে বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। যদি এই তাবিজ বাঁধা অবস্থায় তোমার মৃত্যু হয় তাহলে কখনো সফলকাম হবে না। (সহীহ মুসনাদে আহমদ, হাকেম ইবনে মাজা)৩. হযরত উকবা বনি আমের (রা.) বলেন, আমি স্বয়ং রাসুল (সা.)কে বলতে শোনেছি-অর্থ: যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দিবেন না, আর যে কড়ি ব্যবহার করবে আল্লাহ তাকে মঙ্গল দিবেন না। (মাসনাদে আহমদ, হাকেম)৪. হযরত উক্বা বিন আমের আল-জোহানী (রা.) থেকে বর্ণিত-: একদিন রাসুল (সা.)-এর খেদমতে একদল লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর হুজুর দলের নয়জনকে বয়াত করলেন, কিন্তু একজনকে করলেন না। তারা বললেন, হে রাসুল (সা.) নয়জনকে বয়াত করালেন আর একজনকে বাদ রাখলেন? রাসুল (সা.) বললেন, তার সাথে একটি তাবিজ রয়েছে। তখন তাঁর হাত ভেতরে ঢুকালেন এবং তাবিজ ছিড়ে ফেললেন। অতঃপর তাকেও বয়াত করলেন এবং বললেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করলো সে শিরক করলো। (মাসনাদে আহমদ, হাকেম)৫. হযরত ঈসা বিন আব্দুর রহমান বর্ণনা করেন যে-হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওকাইম (রা.) অসুস্থ ছিলেন। আমরা তাকে দেখতে গেলাম। তাঁকে বলা হলো আপনি কোনো তাবিজ-কবজ নিলেই তো সুস্থ হয়ে যেতেন।তিনি বললেন : আমি তাবিজ ব্যবহার করবো! অথচ এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন-`যে ব্যক্তি কোনো কিছু রাকবচ ধারণ করবে, তাকে ঐ জিনিসের কাছে সোপর্দ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাকেম, তিরমিজী)এভাবে তাবিজাতের বিরুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর প্রচুর হাদিস বা উক্তি রয়েছে। হাদিসে রাসুল (সা.) যেখানে স্পষ্ট তাবিজ-কবচের বিরুদ্ধে বক্তব্য সেখানে এক শ্রেণীর মানুষ কোন সাহসে ইসলামের দোহাই দিয়ে তাবিজ-কবচ ব্যবহার করেছেন এবং যারা বড় বড় সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন, পোস্টার এবং মাইক দিয়ে প্রচার করে তাবিজ-কবচের ব্যবসা করছে ওদের বিরুদ্ধে উলামায়ে ইসলাম কেন জনসাধারণকে সচেতন করতে এগিয়ে আসছেন না। মাজারে গিয়ে কোন কিছু প্রার্থনা করা যেমন পাপ তেমনি তাবিজের মাধ্যমে কিছু প্রাপ্তির আশাও পাপ।তাবিজের পক্ষে একটি দলিল এবং এর উত্তর তাবিজের বিরুদ্ধে অসংখ্য হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর উক্তি থাকার পরও হক্বপন্থী অনেক আলেমকে-এর সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। ফলে মানুষ বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, বিপদ আসার পূর্বে যা লটকানো হয় তা তাবিজ আর বিপদ আসার পর যা লটকানো হয় তা তাবিজ নয়। উলামায়ে ইসলাম এই উক্তির ব্যাখ্যা এ রকম দিয়েছেন যে, হযরত আয়েশা (রা.) মুছিবত আসার পর কুরআনের আয়াতের তাবিজ ব্যবহার জায়েজ বলেছেন কিন্তু মুছিবতের পূর্বে ইহা নাজায়েজ। হযরত আয়েশা (রা.) (আত-তামাইমু) শব্দ দ্বারা ব্যাপকভাবে সকল তাবিজ বুঝাননি। বরং শুধু কুরআনের আয়াতের তাবিজ বুঝানোই তার উদ্দেশ্য। কারণ, অন্যান্য তাবিজাবলী যে রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে এবং পরে সর্বাবস্থায় শিরকের অন্তর্ভুক্ত তা হযরত আয়েশা (রা.) কাছে অজানা ছিলো না। (ফাতহুল বারী)। যারা হযরত আশেয়া (রা.)-এর উক্তিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই যে, হযরত আয়েশা (রা.) যে কথা বলেছেন তা তাবিজ ব্যবহরের পে কোন দলিল নয়, বরং তা হচ্ছে তাবিজ কি?-এর ব্যাখ্যা। তা ছাড়া যেহেতু ইসলামপূর্ব জাহেল যুগ থেকেই তাবিজাতের প্রথা ছিলো, যদি তা বৈধ হতো তবে কুরআন কিংবা হাদিসে স্পষ্ট কিংবা ইঙ্গিতে অনুমতি দেয়া হতো। দেওয়া তো হয়নি বরং বিরোধীতা স্পষ্টভাবে করা হয়েছে। হাদিসে রাসুল (সা.) যে জিনিসের বিরোধীতা করেছেন আমরা কিভাবে মনে করবো হযরত আয়েশা (রা.) সেই জিনিসের পে উক্তি দিয়েছেন। ঝাড়-ফুঁক সম্পর্কে মহানবি (সা.)-এর স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে-: তোমাদের ঝাড়-ফুঁক আমার কাছে পেশ কর, ওটা র্শিকের আওতাধীন না হলে কোন প্রকার বাঁধা নেই। (মুসলিম শহরে নববী)।অথচ তাবিজের পক্ষে রকম কোন উক্তি নবি করিম (সা.) কিংবা সাহাবায়ে কেরামদের নেই বরং নিষেধাজ্ঞার উপর যথেষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
জ্বীন সাধনার মাধ্যমে তাবিজাত কোন আধ্যাত্মিকতা নয়

আমাদের সমাজে কিছু সংখ্যক লোক মূর্খ্যতার কারণে তাবিজ-পিরদের মহত্ত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলে থাকেন যে, হুজুরে কেবলার কিংবা সাহেবে কেবলার জ্বীন তাবে, অর্থাৎ জ্বীন তার কথা শোনে এবং তিনি ওদের সাহায্যে চিকিৎসা করে থাকেন। প্রথমে বুঝতে হবে আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য ছেড়ে যারা জ্বীনের সাহায্য গ্রহণ করে ওদের ঈমান কতটুকু? যাদের ঈমানই প্রশ্নের সামনে ওরা পির কিংবা বুজুর্গ হয় কী করে?

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : অনেক মানুষ অনেক জ্বীনের আশ্রয় নিত, ফলে তারা জিনদের আত্মম্বরিতা বাড়িয়ে দিত। (সুরা: জ্বীন-৬)এই আয়াতের তাফসিরে আল্লামা মুফতি শফি (র.) লিখেছেন যে, ‘জাহেল যুগের মানুষ যখন কোন বিজন প্রান্তরে অবস্থান করতো, তখন প্রান্তরের জ্বীনদের আশ্রয় গ্রহণ করতো। এতে জ্বীনরা অহংকার করতে লাগলো যে, আমরা মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠ। মানুষও আমাদের আশ্রয় গ্রহণ করে।’ (মাআরেফুল কুরআন)।জাহেলী যুগের ইতিহাসে দেখা যায় যে, তৎকালীন মানুষ যখন কোন বিশাল মরুপ্রান্তরে গিয়ে পৌঁছাতো এবং বন্য পশু, ভূত-প্রেত জ্বীন ও শয়তানের আশংকা করতো তখন কাফেলার একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে বলতো যে, আমরা এই উপত্যকার সর্দারের আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং তারা পশু জবাই করে জ্বীনদের নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতো। তাদের কেউ ঘর নির্মাতা কিংবা কূপ খনন করলে জ্বীনদের তিরোধের লক্ষ্যে পশু জবাই করতো। এর পর আস্তে আস্তে মানুষের ধারণা হতে লাগলো পাথর, গাছ-পালা, জীব-জন্তু এবং খনিজ পদার্থের এমন গুণাবলী রয়েছে যে তাদেরকে জ্বীনের তি, মানুষের বদনজর, বিপদাপদ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করতে পারে। ফলে তারা এগুলো দিয়ে তাবিজ বানিয়ে ব্যবহার করতে লাগলো এবং দিন দিন শিরক-এর দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। বর্তমানেও এক শ্রেণীর তাবিজ ব্যবসায়ীর বিজ্ঞাপন পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়, যাতে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে বড় অক্ষরে লেখা থাকে, আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে পাওয়া গাছ কিংবা পাথরের কথা। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, এ সব শিরক এবং মস্তবড় শয়তানী। যারা জ্বীন সাধনার মাধ্যমে তাবিজ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকে ওরা প্রকৃত পক্ষে যাদুর মাধ্যমে জ্বীনের নৈকট্য লাভ করে থাকে। যাদু যারা করে এবং যারা করায় উভয়ই কাফের, এটি হলো উলামায়ে ইসলামের সর্বসম্মতির মত।তাবিজ সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের উত্তরআমরা অনেকেই প্রশ্ন করে থাকি যে, ইসলামে যদি তাবিজের বৈধতা না থাকে তবে এর দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে কীভাবে? এটা একটা যুক্তিসংঘত প্রশ্ন। এই প্রশ্নই করেছিলেন হযরত যয়নাব (রা.) তাঁর স্বামী হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.)কে। মহানবি (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) যখন তাঁর স্ত্রীর গলা থেকে তাগা ছিড়ে বলেছিলেন, আমি নিজে শুনেছি মহানবি (সা.) বলেছেন-‘ঝাড়-ফুঁক তাবিজ এবং ডোরা-সুতা বাঁধা শিরক।’ তখন তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘আপনি এটা কীভাবে বলছেন? একবার আমার চোখ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, আমি অমুক ইহুদীর কাছে যেতাম, সে আমার চোখে ঝাড়-ফুঁক করতো, তখন আমার চু ভালো হয়ে যেতো।’ স্ত্রীর কথা শোনে ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, ‘শয়তান তোমার চোখে গুতো মারতো এবং ঝাড়-ফুঁকের কারণে সে থেমে যেতো।’ (তাফসিরে ইবনে কাসীর)।আজকের যুগেও এই কথা গ্রহণযোগ্য। হয়তো কেউ বলতে পারেন ইবনে মাসউদ (রা.) স্ত্রী ইহুদীর কাছে ঝাড়-ফুঁকের জন্য যেতেন, তাই মুসলমানদের ঝাড়-ফুঁকের বেলায় এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। তাবিজের দ্বারা রোগমুক্তি হওয়া যদি তাবিজাতের বৈধতার জন্য দলিল হতো তাহলে ইহুদী ব্যক্তির ঝাড়-ফুঁকে সুস্থ্য হওয়াটাও বৈধতা ঘোষণা করতো। এ ছাড়া বর্তমানকালেও আমরা দেখতে পাই ইহুদী, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁকের প্রচলন রয়েছে। ওদের ঝাড়-ফুঁকের দ্বারা তাদের বিশ্বাসীরা যে সুস্থ কিংবা উপকৃত হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। আমাদের ভারতবর্ষের মাজার বিশ্বাসীরা মাজারে মানত করে যে, কিছু উপকৃত হচ্ছে না তা-তো বলা যাবে না। তাহলে কি কেউ বলতে পারবেন যে ওরা সবাই সত্যপন্থী? বাস্তবে এখানে যে উপকার হচ্ছে তা পূঁজিবাদি অর্থনীতির মতো অতি সামান্য এবং উপস্থিত। ইসলাম উপস্থিত এবং অতি সামান্য উপকারের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী সমাধানের, যা ইহকাল ও পরকালের উপকারে আসে। ইসলাম শুধু অন্ধ বিশ্বাসের নাম নয় রবং এখানে বিশ্বাসের সাথে কিছু নিয়ম-নীতি, কিছু আদেশ-নিষেধ রয়েছে। নিজকে মুসলমান দাবি করতে হলে এ সব জানতে হবে, অতঃপর বিশ্বাসের সাথে মানতে হবে, বাস্তব জীবনে আমল করতে হবে। এ সব হতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর বিধানানুসারে। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তাবিজাত শিরক, এটাই মুসলমানদের জন্য শেষ সিদ্ধান্ত।’ এরপর তাবিজাত যতই উপকারে আসুক না কেন, ঈমানদারগণ তা গ্রহণ করতে পারেন না, তবে যেহেতু এ গ্রহে শুধু মুসলমানদের বসতি নয় তাই ইসলামি দার্শনিকগণ ইসলামি নিয়ম-নীতি এবং আদেশ-নিষেধের যুক্তিসঙ্গত এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, দিচ্ছেন এবং আগামীতেও দিবেন। যারা তাবিজাতের বৈধতা ঘোষণা করতে উপকারকে উস্থাপন করেন তাদের জন্য বিজ্ঞানসম্মত একটি উত্তর রয়েছে। লন্ডনের আমার এক বাংলাদেশী বন্ধু (তিনি অবশ্য কোনো প্রকার জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী না) তরুণ বিজ্ঞানী ড. পারভেজ ইকবাল একবার আমেরিকা গিয়েছিলেন মেডিসিনের উপর গবেষণা করতে। ফিরে এসে আমাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, বাস্তবে ঔষধ বিশেষ করে আধুনিক ঔষুধগুলো মানুষের উপকার থেকে অপকার বেশি করে। তবে উপস্থিত একশনের জন্য আমরা এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছি। আমি আমেরিকায় গবেষণা করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক রোগীকে প্রকৃত ঔষধ দিলাম এবং কিছু সংখ্যককে রঙিন পানি। যারা ঔষধ সেবনকারী ওদের থেকে বেশি সুস্থ্য হয়েছে পানি সেবনকারীরা। ঔষধ সেবনকারীদের অনেকের সাইট এফেক্ট করলেও পানি সেবনকারীদের সাইড এফেক্ট হয়নি। বাস্তব কথা হচ্ছে মানুষের আসল রোগ হচ্ছে হৃদয়ে। এ সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমণ্ড ফ্রয়েডের বক্তব্য হচ্ছে যে, ‘মানুষের বেশিরভাগ রোগের উৎপত্তি তার মনে, তাই মানষিক চিকিৎসাই হচ্ছে রোগ নিরাময়ের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।’ ফ্রয়েডের বক্তব্য এবং ড. পারভেজ ইকবালের গবেষণা থেকে আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি তাবিজাতে রোগমুক্তি কেন আসে। ফ্রয়েড ১৮/১৯ শতকে যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা বাস্তবে হাজার বছর পূর্ব থেকেই মানুষের অনুভূতিতে ছিলো কিন্তু ইসলাম ছাড়া কেউ এর সমাধান দিতে পারেনি। সত্যপন্থীদের নিরবতার কারণে ব্রিটিশ শাসনকালে পাক, ভারত, বাংলায় ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় এক শ্রেণীর মুসলমান বিভিন্ন প্রকার র্শিককে ইসলামে সংযুক্ত করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আর ওদেরই প্রভাবে এবং প্রচেষ্টায় গড়ে উঠলো মাজারকেন্দ্রীক ভণ্ডামী ও তাবিজের জমজমাট ব্যবসা। মুর্খতার কারণে সাধারণ মানুষের একটি বিরাট অংশ ওদের আনুগত্য করতে লাগলো। এরপর যখন দেখা গেলো বিনা পুঁজির জমজমাট ব্যবসা-মাজার ব্যবসা কিংবা তাবিজ ব্যবসা, তখন ব্রিটিশ শাসনের পরও তা চলতে থাকলো এবং আজও আছে। সত্যপন্থী উলামাদের নিরবতা ভঙ্গ না হলে তা আরো কতকাল যে স্থায়ী হয়ে থাকবে-সে কথা আল্লাহ ভালো জানেন!আমাদের সমাজে অনেকে বলেন, তাহলে মেডিক্যাল চিকিৎসাও র্শিক, না এটা যুক্তিহীন দাবি। ইসলাম ঔষধ ব্যবহারকে তাবিজের মতো র্শিক বলেনি বরং বলেছে তোমরা প্রয়োজনে ঔষধ ব্যবহার কর এবং স্বয়ং নবি করিম (সা.)ও সিংগা লাগিয়েছেন। তাছাড়া কুরআন-হাদিসে বিভিন্ন রোগের বিভিন্ন দোয়া রয়েছে তা পাঠ করলে ইনশাল্লাহ রোগ নিরাময় হবে। স্বযং রাসুল (সা.) এগুলো পাঠ করতেন। এগুলো দ্বারা কোনো বুজুর্গকে দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করানো অবশ্য ইসলামে বৈধ। কিন্তু একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, নিজের দোয়া নিজের জন্য বেশি কবুল হয়; তাই এই সমস্ত দোয়া শিখে নিজেরা আমল করুন। এই সমস্ত দোয়ার অনেক বই বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়। স্মরণ রাখতে হবে পির সাহেবের দোয়া থেকে বেশি কবুল হয় বাচ্চার জন্য মা-বাবার দোয়া। হাদিসে আছে, ‘দান খয়রাতে বিপদ-আপদ দূর হয়।’ যে পির সাহেব বিরাট বাড়ি-গাড়ি এবং প্রতিদিন মোরগ-মসল্লম খাদ্য গ্রহণ করেন তাকে দান খয়রাত করার চেয়ে, বেশি উপকৃত হবেন মজলুম মুস্তাদাফিন অর্থাৎ অসহায় মানুষকে দিলে। সর্বশেষে মহান আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থনা-তিনি যেন আমাদেরকে সত্যপথে পরিচালিত করেন!

তাবিজ-কবজ সম্পর্কে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বক্তব্য এবং এর জবাব
প্রসঙ্গ : তাবি-কবজ ও ঝাঁড়-ফুঁক : মাওলানা মুহিউদ্দিন খান

প্রকাশ: ৯ আগষ্ট ২০০০ খ্রিস্টাব্দ,

সাপ্তাহিক ইসলামিক সমাচার, লন্ডন।

................................................................
প্রসঙ্গ কথা

লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইসলামিক সমাচারের ৯আগষ্ট ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তাবিজের পক্ষে ‘প্রসঙ্গ : তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁক’ শিরোনামে জনপ্রিয় ইসলামী ম্যাগাজিন মাসিক মদিনার সম্মানিত সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। আমরা এখানে প্রথমে খান সাহেবের এই লেখা পাঠ করবো, তারপর শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করবো তাঁর বক্তব্যের সত্যতা।

আমাদের সমাজে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। বুজুর্গ আলেম ও পির-মাশায়েখগণ জানা-অজানা নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকজনকে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ দিয়ে থাকেন। আর বিপদগ্রস্ত লোকজন এসব ব্যবহার করে উপকার লাভ করেন। এসবের প্রচলন আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে।ইদানিং এক শ্রেণীর লোককে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজকে হারাম, শেরেকী আমলরূপে সাব্যস্ত করতে তৎপর দেখা যায়। সুতরাং ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজের বৈধতা শরীয়তের দলীলদ্বারা প্রমাণ এবং তৎসঙ্গে যারা এগুলিকে হারাম সাব্যস্ত করে থাকেন ও এই চরম সিদ্ধান্তের অনুকূলে কিছু দলীল-প্রমাণ ও যুক্তির অবতারণা করেন, সেগুলি অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে।বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হালাল এবং হারামের দলীল আমাদিগকে কুরআন এবং সুন্নাহ্ থেকেই গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বা সুন্নায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বা ইশারা-ইঙ্গিতেও যদি কোন বিষয়ের বৈধতার দলীল থাকে, তবে সে বিষয়টাকে সরাসরি হারাম বলা চরম ধৃষ্ঠতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। তাছাড়া যুগ পরম্পরায় নির্ভরযোগ্য আলেমগণের আমলও শরীয়তের একটি দলীলরূপে গণ্য। শেষোক্ত এই দলীলটিকে ‘এজমায়ে উম্মত’ বলা হয়।পবিত্র কুরআনের অনেকগুলি আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য শেফা ও হেদায়াতের উৎস।’ আলোচ্য আয়াতগুলোতে উল্লেখিত ‘শেফা’ শব্দের তফসীরে শাহ্ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) লিখেছেন, ‘কুরআন শরীফের চাইতে ব্যাপক উপকারী এবং মানবজাতির রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী আর কিছু নাযিল হয়নি।’ যেমন বলা হয়েছে, ‘আর আমি কুরআনে এমন কিছু আয়াত নাযিল করেছি যা মু’মিনদের জন্য শেফা এবং রহমত স্বরূপ।’ (বনী ইস্রাঈল: ৮২)এতদসঙ্গে পবিত্র কুরআনের আয়াতে শেফা নামে পরিচিত আয়াতগুলোর কথা উল্লেখ করা যায়। আয়াতগুলো হচ্ছে :১. সুরা তাওবার ১৪ নং আয়াত, ২. সুরা ইউনূসের ৫৭ নং আয়াত, ৩. ছুরা নাহ্লের ৬৯ নং আয়াত, ৪. সুরা বনী ইস্রাঈলের ৮২ নং আয়াত, ৫. সুরা আশ্-শোয়ারার ৮৫ নং আয়াত এবং ৬. সুরা হা-মীম ছাজদার ৪৪ নং আয়াত। উপরোক্ত প্রতিটি আয়াতেই কুরআনে মুমিনদের জন্য ‘শেফা’, ‘রহমত’ প্রভৃতির কথা উল্লেখিত হয়েছে। তফসীরবিদ ইমাম বায়হাকী (রহ.) ‘শেফা’ অর্থ আত্মা এবং দেহ উভয়ের শেফা বা নিরাময় বলেছেন। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে যেমন আত্মার যাবতীয় রোগ এবং মন্দ প্রবণতার চিকিৎসা রয়েছে, তেমনি দেহের যাবতীয় রোগ-ব্যাধীরও চিকিৎসা রয়েছে।কুরআনের আয়াত দ্বারা রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে এ কথা অনুধাবন করার জন্য শেষ দু’টি সুরার তফসীর ও শানে-নুযুল পাঠ করাই যথেষ্ট। উল্লেখ্য যে, এই দুইটি সুরা হযরত নবি করীম (সা.)-কে যাদু করার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল। আল্লাহ্পাক যাদুর প্রতিকার করার উদ্দেশ্যে সুরা দু’টি দান করেছিলেন।ইমাম কুশাইরী (রহ.) তাঁর মারাত্মক অসুস্থ শিশুপুত্রের চিকিৎসার লক্ষ্যে যে আয়াতে ‘শেফা’ পাত্রে লেখে তা পানিতে ধুয়ে পান করিয়েছিলেন। ফলে মৃতকল্প শিশুটি আশ্চর্যজনকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। ইমাম সাহেব এই তদবীরটি একটি মোবারক স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে করেছিলেন। তারপর থেকে আয়াতে ‘শেফা’ গুরুতর অসুস্থতা নিরাময়ের লক্ষ্যে যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম তাজউদ্দীন সুবকী (রহ.) রোগ-ব্যাধী নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আয়াতে শেফা এবং পবিত্র কুরআনের অন্য কয়েকটি আয়াতের ব্যবহার সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা শেষে মন্তব্য করেছেন যে, ‘আমাদের মাশায়েখগণ রোগ-ব্যাধী নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনের আয়াত ব্যবহার করতেন।’হাদিস শরীফের সহীহ্ বর্ণনায় বিচ্ছুর দংশনজনিত বিষ নিরাময়ের দোয়ার উল্লেখ আছে। সুতরাং ঝাড়-ফুঁক কুরআন-হাদিস পরিপন্থী, এমন কথা বলা মোটেও বাস্তবতা-সংগত নয়।সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) শিশুদিগকে সর্বপ্রকার ভয়-ভীতি ও আপদ-বালাই থেকে নিরাপদ থাকার একটি দোয়া শিক্ষা দিতেন। যারা দোয়াটি উচ্চারণ করতে সম হতো না তাদের জন্য দোয়াটি কাগজে লিখে তা ওদের গলায় ধারণ করতে দিতেন। [যাদুল-মাআদ]হাদিস শরীফের কোনো কোনো বর্ণনায় ‘তাবিজ’ শব্দটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয় যে, ঝাড়-ফুঁক যেমন একটি মছনূন আমল, তেমনি তাবিজ ব্যবহারও সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে প্রচলিত একটি বৈধ আমল।আবু দাউদ এবং ইবনে মাজাহ্ শরীফে ‘রোক্বা তামায়েম ও তোলা হারাম’ উল্লেখ করে যে হাদিসটি বর্ণনা করা হয়েছে, সে হাদিসের তিনটি শব্দ রোক্বা অর্থ-দুর্বোধ্য বা শেরেকী শব্দাবলী সম্বলিত ঝাড়-ফুঁক, তামায়েম অর্থ-তন্ত্রমন্ত্র লিখিত তাবিজ এবং তোলা অর্থ-তুক-তাক বা যাদুমন্ত্র। জাহেলিয়াতের যুগে যেমন এসবের প্রচলন রয়েছে। এসব কুফরী যাদুমন্ত্রের ব্যবহার যে হারাম তাতে কারো দ্বিমত নাই।ইবনে মাজাহ্ শরীফে হযরত আলী (রা.)কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে আছে যে, সর্বাপো বড় নিরাময়কারী হচ্ছে কুরাআন। ইমাম বায়হাকী (রহ.) ও শাফী (রা.) আয়াতে শেফার তফসীরে পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কিত দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ ‘মাওয়াহেবে রাদুন্নিয়া’ নামক বিখ্যাত কিতাবে আলোচিত হয়েছে। এতদসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, কুরআনের আয়াত বা হাদিস শরীফে উল্লেখিত দোয়া কালাম পাঠ করে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে সমান উপকার পাওয়া যায়।ইমাম কুশাইরী (রাহ.) ঝাড়-ফুঁক এবং তাবিজকে দোয়ার বিকল্পরূপে উল্লেখ করেছেন। কারণ, দোয়া তাবিজ এবং ঝাড়-ফুঁক প্রভৃতি সবকিছুতেই আল্লাহর নামের ওছিলা গ্রহণ করে আল্লাহ্র নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, যা অবৈধ হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং এগুলিও একান্তভাবে আল্লাহ্র নিকটই সাহায্য প্রার্থনার একটি পদ্ধতিরূপে গ্রহণযোগ্য। এই গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিকে কুফুরী ও জাহেলিয়াত যুগের শেরেকী কালামের কুফুরী ও জাহেলিয়াত যুগের শেরেকী কালামের সাথে একাকার গণ্য করা মোটেও যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

---------------------------------------------

জবাব : সৈয়দ মবনু

প্রসঙ্গ কথা

প্রিয় পাঠক, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি আমার প্রচুর শ্রদ্ধা থাকার পরও এই লেখাটির দুর্বল দিক পর্যালোচনা আমাকে করতেই হলো। ২৫ অক্টোবর এবং ৮ নভেম্বর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের সাপ্তাহিক ইসলামিক সমাচারের দুই সংখ্যায় আমার ‘তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁক প্রসঙ্গে’ প্রকাশিত হয়।

১) ব্রিটিশ শাসনের দুইশত বছরের প্রভাবে ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজে যেমন ইসলামিশিক্ষা হ্রাস পেয়েছিলো তেমনি সহী-উল-আকায়েদ ইসলাম থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ভণ্ডপির এমনকি মিথ্যা নবুওতের দাবিদারও জন্মে ছিলো। ওদেরই প্রভাবে একসময় পাক-ভারত-বাংলায় এক শ্রেণীর লোক জীবিকার মাধ্যম হিসেবে তাবিজ-কবজের ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে তা অনেকটা জমজমাট ভাবেই চলছে। পত্রিকাগুলোর বিজ্ঞাপন দেখলেই ব্যাপারটা অনুমানে আসবে। তাবিজ-কবজের সাথে অনেকে কুফরী যাদু-মন্ত্র ও করছেন বলে শোনা যায়। অনেকে আবার ইসলামি চিকিৎসা পদ্ধতি বলে এগুলোর মহত্ব বর্ণনা করে থাকেন। এই প্রোপটে আজ থেকে দু-এক বছর পূর্বে লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা ও সাপ্তাহিক ইসলামিক সমাচার পত্রিকায় ‘কুরআন-হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত পাঠকের সহযোগিতায় ঈদুল আযহা দুই হাজার সাল উপলে তা সিলেট থেকে গ্রন্থাকারে বের হয়। অন্যদিকে আমার বন্ধু-বান্ধব এবং শ্রদ্ধাভাজনেষু পরিচিতজনদের মধ্যে যারা প্রত্য বা পরো তাবিজ ব্যবসার সাথে জড়িত, তারা বিভিন্নভাবে ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। অনেকে গালি-মন্দও দিয়েছেন। দু-চার জন এমনও আছেন যারা টাকার লোভ দেখিয়ে বলেছেন, তাবিজের বিরোধীতা না করতে। তাদের কোন কিছুই আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি, কারণ এক্ষেত্রে আমি শায়খুল ইসলাম ইমাম তকিউদ্দিন ইবনে তায়মিয়া (রা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত। আমি তাদেরকে স্পষ্ট বলেছি, তাবিজের বিরুদ্ধে আমি যে হাদিসগুলো নকল করেছি সেগুলোকে যদি আপনারা সহী মনে না করেন তবে দলিল দিন। অথবা আপনারা তাবিজের পে সহী দলিল উপস্থাপন করুন। এই পর্যন্ত তারা তা পারেননি বা সে দিকে চেষ্টা না করে নানা কথার মালা গেঁথে মূল বিষয়কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, কোন ঈমানদারের সামনে সহী-উল-আকায়েদ ইসলাম উপস্থাপন করলে সে মানতে বাধ, যেহেতু তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর বিশ্বাস, রাসুলের আনুগত্য এবং বেহেস্তের প্রত্যাশা।আমাদের সমাজে আবহমানকাল থেকে প্রচলিত বলেই কেউ কেউ তাবিজ-কবজের বৈধতা ঘোষণা করেন। তাদের অবশ্যই বুঝা উচিত যে, কোন কিছু যতই পুরাতন হোক যদি তা কুরআনে সুন্নায় প্রত্য-পরো বা ইশারা-ইঙ্গিতে না থাকে তবে তা দ্বীনি কাজ মনে করে পালন করা বিদআত। আর যদি তা কুরআন-হাদিসের বিধান পরিপন্থী হয় তবে হারাম। বিদআত কিংবা হারামে কিছু সাময়িক উপকার হলে তা বাস্তবিক দিকে প্রচুর তির কারণ। মহানবি (সা.) বলেছেন-‘সর্বোত্তম বক্তব্য আল্লাহর বক্তব্য। সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা রাসুল (সা.)-এর জীবন ব্যবস্থা। সব চাইতে নিকৃষ্ট কাজ ইসলামের ভেতর নতুন কিছু (বিদআত) সৃষ্টি করা। প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। (মুসলিম শরিফ)স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা-‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আইন অমান্য করে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিপে করা হবে।’ (সুরা নিসা- ১৪)তাই আবহমান কাল থেকে প্রচলিত কাজ যদি কুরআন-হাদিস ভিত্তিক না হয়, তবে তা অবৈধ। অনেকে ঝাঁড়-ফুঁক এবং দোয়ার বিধান দিয়ে তাবিজ-কবজের কিয়াস করেন। কুরআন-হাদিস-ইজমা-কিয়াসের মাধ্যমে ইসলামের বিধান প্রণীত হয়। তবে ইজমা ও কিয়াস তখন-ই বৈধ হয় যখন কুরআন-হাদিস কিংবা হযরতে সাহাবা-এ-কিরামের আমলে পাওয়া যায়। আমাদের বুঝা উচিত যে, তাবিজ-কবজ আর ঝাঁড়-ফুঁক কিংবা দোয়া এক জিনিস নয়। ঝাঁড়-ফুঁক শিরক্ মুক্ত হলে অসুবিধা নেই তা স্বয়ং রাসুল (সা.) বলেছেন। আর দোয়া নিজের জন্য বা অন্যের জন্য তাতো বড়ই ফাজিলতের কাজ। নবি-রাসুল, সাহাবাসহ আল্লাহর প্রত্যেক নেক বান্দারা দোয়া করেছেন এবং তাদের অনুসারীগণ আজো করছেন । পবিত্র কুরআনে -হাদিসে বিভিন্ন বিষয়ে দোয়া রয়েছে, এসব পাঠ করলে উপকার হয়। তবে এগুলোর সাথে তাবিজ-কবজের কোন সম্পর্ক নেই। তাবিজ-কবজ বৈধ হয় কিভাবে যেহেতু এসবের বিরুদ্ধে স্পষ্ট রাসুল (সা.)-এর হাদিস রয়েছে। (হাদিসগুলো দেখতে পারেন কুরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত র্শিক নয় কি? পর্বে)। অনেকে বলেন, ‘ইমান কুরাইশী (রা.) তাঁর অসুস্থ শিশু সন্তানের চিকিৎসা করেছেন একটি পাত্রে আয়াতে শিফা লিখে তা পানি দিয়ে ধুয়ে পান করিয়ে।’(মাওলানা মহিউদ্দিন খান, প্রসঙ্গ: তাবিজ-কবজ ও ঝাড়-ফুঁক, ইসলামিক সমাচার, লন্ডন, বর্ষ-২, সখ্যা-৬৫, পৃ. ৫)। আমি বলবো, হয়তো তিনি করেছেন। কিন্তু তাঁর ঘটনা কি প্রামণ করে না যে তাবিজ-কবজ উচিত নয়? তিনি যদি আয়াতে শিফা কাগজে লিখে কবজে ডুকিয়ে তাগায় বেঁধে শরীরে ঝুলাতেন তবে একটা কথা ছিলো। তারপরও এই ঘটনা দলিল হতো না যেহেতু এর বিরুদ্ধে হাদিসে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে, হযরতে সাহাবা কিরাম (রা.)এর বিরোধীতা করেছেন এবং তিনি তা করেছেন শিশুবাচ্চার ক্ষেত্রে। বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) শিশুদেরকে ভয়-ভীতি ও আপদ-বিপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য একটি দোয়া শিক্ষা দিতেন। যারা দোয়া পাঠে অম হতো তাদের জন্য লিখে গলায় বেঁধে দিতেন।(আবু দাউদ এবং যাদুল মাআদ)।অনেকে এই ঘটনাকেও তাবিজের দলিল মনে করেন। এটা তাবিজ-কবজের দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মা’জুর (যে কোনো কারণে অম) ব্যক্তিদের জন্য শরিয়তের বিধান সাধারণ বিধান থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই মা’জুরদের মাসআলা দিয়ে সাধারণ মাসআলার কিয়াস হয় না। বাচ্চাদের ব্যাপারে ও তাই। বোখারি শরিফে দুইটা হাদিস রয়েছে বাচ্চরা মহানবি (সা.) এর সামনে বাজনা বাজিয়ে গান গেয়েছে। একটা ছিলো ঈদের দিন, স্বয়ং হযরত আয়েশা (রা.)-এর কে। যে হযরত আবু বকর (রা.) এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করলে স্বয়ং রাসুল (সা.) এর উত্তরে বলেন, ‘আবুবকর তুমি ওদের প্রতি রাগ করো না। প্রত্যেক জাতিরই বিশেষ কিছু দিন থাকে আনন্দ-উৎসবের। আজ মুসলিম উম্মাহের সেই দিন।’অন্য ঘটনাটি ঘটে হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রা.)-এর বিয়ের মাহফিলে। কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে বাজনা বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে মহানবি (সা.)-এর সামনে থমকে দাঁড়ালো। রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা বন্ধ হলে কেন? চালিয়ে যাও।’এই দুই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে শরীয়তের বিধান মতো যারা বাচ্চা তারা বিয়ে কিংবা ঈদে বাজনা বাজিয়ে গান করতে পারে। তবে বয়স্কদের জন্য বাজনা হারাম। এখন যদি এই হাদিস দু’টি উপস্থাপন করে ফতোয়া দিয়ে বসেন যে, ইসলামে বাদ্যযন্ত্র বৈধ হবে, তবে তা চরম ধৃষ্টতা বলেই প্রমাণিত হবে। তেমনি তাবিজ-কবজের ব্যপারটাও। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) কিংবা ইমাম কুরাইশী (রহ.) এর ঘটনা ছিলো শিশু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। তাই এই ঘটনাসমূহ সাধারণভাবে তাবিজের বৈধতা প্রমাণ করে না।তাবিজের বৈধতা ঘোষণা করতে অনেকে পবিত্র কুরআনের যে সব আয়াতে প্রত্য-পরো শিফা শব্দ রয়েছে সেগুলো উপস্থাপন করে থাকেন। তারা ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে যে সব আয়াতের নম্বর আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন আসুন আমারা সে সব আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা, শানে নুজল খুলে দেখি কোথাও তাবিজ-কবজের কথা বলা হয়েছে কি? লন্ডনের পাকি ইসলামিক সমাচার (বর্ষ-২, সংখ্যা- ৬৫) এ আমাদের অনেকেরই শ্রদ্ধাভাজনেষু হযরত মাওলানা মহিউদ্দিন খান তাবিজের পক্ষে যে সব আয়াতের নম্বর দিয়েছেন পাঠকদের সামনে সেগুলোর অর্থ-ব্যাখ্যা সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। ১.সূরা তাওবার ১৪ নম্বর আয়াত...........অর্থ : ‘যুদ্ধ কর ওদের সাথে, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদের শাস্তি দিবেন। তাদের লাঞ্ছিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জয়ী করবেন এবং মুসলমানদের অন্তর সমূহ শান্ত করবেন।’এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে জিহাদের মাধ্যমে যে বিজয় আসবে তাতে মুসলমানদের অন্তর সমূহ শান্ত হবে।‘ এখানে তাবিজের কথা নয়। বলা হয়েছে জিহাদের কথা।২. সূরা ইউনূসের ৫৭ নম্বর আয়াত.......অর্থ : হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের প থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য।’এই আয়াতে ‘শিফা’ শব্দের সাথে ‘ছুদুর’ শব্দ যুক্ত হয়েছে। ‘ছুদুর’ হলো ‘ছদর’ শব্দের বহুবচন। আভিধানিক অর্থ-বুক, মুফাচ্ছেরগণ অর্থ উঠিয়েছেন-অন্তর।হযরত হাসান বসরী (রাহ.) বলেন, ‘পবিত্র কুরআনের এই বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বোঝা যায় যে এটি বিশেষত অন্তরের রোগের শিফা; দৈহিক রোগের চিকিৎসা নয়।(রুহুল মা’আনী)।শায়েখ ইমাদুদ্দিন ইবনে কসির (রাহ.) বলেন, ‘বান্দার উপর স্বীয় ইহসানের বর্ণনা দিতে আল্লাহ পাক এই আয়াত নাজেল করেন।...এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘এটা তোমাদের অন্তরের সন্দেহ, সংশয়, কালিমা ও অপবিত্রতা দূরকারী।’(তফসীরে ইবেন কাসির)৩. সুরা নহলের ৬৯ নম্বর আয়াতঅর্থ : এরপর প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার কর। অতঃপর তোমাদের প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ কর; তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগমুক্তি; নিশ্চয় এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল স¤প্রদায়ের জন্যে।’ এই আয়াতে ‘ফি’হীস শিফা-উ-লিননাস’ বাক্য দিয়ে আল্লাহ পাক তাবিজ-কবজের কথা বলেননি। আয়াত দ্বারাই স্পষ্ট এখানে মধুর কথা বলা হচ্ছে। এত স্পষ্ট করে বলার পরও কেউ যদি মনে করেন এটা তাবিজ-কবজ সম্পর্কিত তবে তিনি ভুলে আছেন। কেউ কেউ অবশ্য এই আয়াতের ‘ফি হীশ শিফা-উ-লিননাস’ বাক্যে কুরআনের দিকে ইঙ্গিতের কথা মনে করেন। হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির (রা.) তা খণ্ডন করে বলেছেন, ‘কুরআনে শিফা রয়েছে তা সত্য কিন্তু এখানে শুধু মধুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।৪. সূরা বনী ইসরাঈলের ৮২ নম্বর আয়াত-------অর্থ : আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনদের জন্য রহমত।’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাচ্ছিরগণ একমত, এখানে যে শিফা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এর দ্বারা পাপ মুক্তি বুঝানো উদ্দেশ্য। যেমন, এই আয়াতেরই শেষ অংশে বলা হয়েছে ‘গোনাহগারদের তো এতে শুধু তিই বৃদ্ধি পায়।’ এখানে গোনাহকে একটা রোগ বলা হয়েছে এবং আর যারা কুরআনকে গ্রহণ করলো তারা সেই রোগ থেকে মুক্তি পেলো। আর যারা অমান্য করলো তারা তিগ্রস্ত হলো। যেমন সূরা বাকারায় বলা হয়েছে-‘এটা এমন এক কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং তা পথ প্রদর্শক মুত্তাকীদের জন্যে। (সূরা বাকারা- ২)।এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, যারা মুত্তাকী হতে চায় তারাই এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন থেকে উপকৃত হয়ে থাকে। এবং যারা উপকৃত হতে চায় না তারা তিগ্রস্ত হয়। হাফেজ ইবনে কাসির (রা.) সূরা বনী ইসরাঈলের ৮২ নম্বর আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তাঁর সেই কিতাব সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, পবিত্র কুরআন ঈমানদারদের অন্তরের রোগসমূহের জন্য শিফাস্বরূপ। সন্দেহ, কপটতা, শিরক, বক্রতা, মিথ্যার সংযোগ ইত্যাদি সবকিছু এর মাধ্যমে বিদূরিত হয়। ঈমান, হিকমতহ, কল্যাণ, করুণা, সৎকার্যের প্রতি উৎসাহ ইত্যাদি এর দ্বারা লাভ করা যায়। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।মুফতি শফি (রা.) বলেছেন, ‘কুরআন পাক অন্তরের ঔষুধ এবং শেরক, কুফর, কুচরিত্র ও আত্মিক রোগ সমূহ থেকে মনের মুক্তিদাতা।’ (মাআরেফুল কুরআন, বাংলা অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান)। কোনো কোনো আলেম এই আয়াতের শিফা শব্দের শারীরিক রোগ মুক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তারা উদাহরণ স্বরূপ হযরত আবু সাইদ খুদর্রী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত ঐ হাদিস নকল করেল যে, ‘এক দল সাহাবি (রা.) সফর থেকে ফিরে হযরত নবি করিম (সা.)কে বললেন-‘এক গ্রামের সর্দারকে বিচ্চু দংশন করলে লোকেরা আমাদের কাছে আসে চিকিৎসার জন্য। আমরা সাতবার সূরা ফাতেহা পড়ে রোগীর গায়ে ফুঁ দিলে সে সুস্থ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) এই কাজকে জায়েজ বলে স্বীকৃতি দিলেন।’ এই হাদিস দ্বারা তাবিজ-কবজের বৈধতা প্রমাণিত হয় না। শিরক মুক্ত ঝাঁড়-ফুঁক বৈধ হওয়ার ব্যাপারে তো কারো কোনো সন্দেহ নেই।৫. সূরা আশ-শোআরা-৮৫ নম্বর আয়াত..................অর্থ : ‘আমাকে নেয়ামত উদ্যানের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।’এই আয়াত হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দোয়ার একটি অংশ। দোয়া শুরু হয়েছে ৮৩ নম্বর আয়াত থেকে।হযরত ইব্রাহীম (আ.) মুশরিকদের সামনে বক্তব্য শেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেনÑহে আমার পালনকর্তা আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর এবং আমাকে নেয়ামত উদ্যানের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর।(সূরা আশ-শোআরা-৮৩-৮৫)।এখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ‘নেয়ামত’ শব্দ দিয়ে অবশ্যই তাবিজ-কবজের দিকে ইঙ্গিত করেননি। আর নিয়ামত উদ্যানের অধিকারী বলতে তাবিজ-কবজ দাতাদের কথা বলেননি। তিনি আকাক্সা প্রকাশ করেছেন বেহেস্তের। এখানে নিয়ামত শব্দ দিয়ে বেহেস্ত বুঝানো হয়েছে।৬. সূরা হা-মীম সেজদাহ-৪৪ নম্বর আয়াত.........অর্থ : আমি যদি অনারব ভাষায় কুরআন পাঠাতাম তবে অবশ্যই তারা বলতো-এর আয়াত সমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষার আর রাসুল আরবি ভাষী। বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার এবং যারা মুমিন নয় তাদের কানে আছে ছিপি আর কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্ব।’ এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কুরআন অস্বীকারকারীদের কানে ছিপি আর চোখ অন্ধ এবং যারা ঈমান এনেছে কুরআনে বিধান মতো নিজেদের জীবন পরিচালিত করেছে তারা এই রোগ থেকে মুক্ত। মুফাচ্ছিরগণ সবাই একমত যে, এই আয়াতে কুরআনের মাধ্যমে কুফর, শিরক, অহংকার, হিংসা, লোভ, লালসা ইত্যাদি আত্মিক রোগ নিরাময় হওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। অবশ্য অনেকে বলেছেন, দৈহিক রোগের ও প্রতিকার কুরআনী দোয়া পাঠের দ্বারা সম্ভব। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি ঝাঁড়Ñফুঁক দেয়ার ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো তাবিজ-কবজ নিয়ে। যে আয়াতগুলো আমরা দেখলাম তাতে কি তাবিজের পে প্রত্য বা পরো কোনো দলিল রয়েছে? ইহুদীরা নবি করিম (সা.) কে যাদু করে ছিলো। তা প্রতিকারের জন্য আল্লাহ পাক সূরা ফালাক্ব এবং সূরা নাস প্রেরণ করেন। আমার অনেক শ্রদ্ধাভাজন হযরত মাওলানা এই ঘটনা দিয়ে তাবিজ-কবজের দলিল খুঁজেছেন। অথচ হযরত রাসুল (স.) এই সূরা দুটিকে তাবিজ-কবজ হিসেবে ব্যবহার করেননি। তিনি তা দোয়া হিসেবে পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁক দিয়েছেন। আজো সহী-উল-আকায়েদ প্রত্যেক উলামায়ে কিরাম ফজরের এবং মাগরিবের নামাজের পর আয়াতুল কুরসী এবং চার কুল পড়ে নিজেদের শরীরে ফুঁক দিয়ে থাকেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমাদের মুসলিম সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির ল্েয মানুষকে সহী-উল-আকায়েদ ইসলাম থেকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার যে সকল প্রিয়জন ও শ্রদ্ধাভাজনরা ইসলামের পোশাক গায়ে দিয়ে তাবিজ-কবজের ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের কাছে বিনীত নিবেদন এই যে, ‘সহী-উল-আকায়েদ’ চিন্তে করে অন্য কোনো ব্যবসা খুঁজে বের করুন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। আর ব্যবসাতো আমাদের নবি করিম (সা.) এর সুন্নত। অবশ্য বর্তমানে কিছু সংখ্যক আলেম তাবিজ-কবজের ব্যবসাকে লজ্জাজনক মনে না করলেও কলকারখানা কিংবা এই রকমের শ্রমিকের কাজকে লজ্জাজনক মনে করেন। আমি তাদেরকে প্রায়ই প্রশ্ন করি, আপনি কি রাসুল (সা.) কিংবা সাহাবা-এ কিরাম থেকে বড় আলেম? আপনি কি ওদের থেকে বড় পির? রাহমাতুল্লিল আলামীন হয়েও যদি রাসুল (সা.) ইহুদীর ঘরে মজুর হিসেবে চাকুরী করতে পারলেন, আর যে আলী (রা.)-এর কথা স্বয়ং রাসুল (সা.) বলছেন, ‘আমি যদি হই জ্ঞানের ঘর হবে আলী সেই ঘরের দরজা।’ সেই আলী অন্যের ঘরে চাকুরী করেছেন নিজের পরিবার চালাতে। আরো অসংখ্যা ঘটনা রয়েছে। ইসলাম কোনো পাদ্রীইজম কিংবা ব্রাহ্মণ্যবাদীতার নাম নয়। ইসলাম হলো কুরআন-সুন্নার প্রতিটি আদেশ-নিষেধকে সহী-উল-আকায়েদ বিশ্বাসের সাথে আমলের নাম। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন কুরআন-সুন্নার নীতিতে চলার তৌফিক দেন।

তাবিজের পক্ষে সিলেটের আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসার ফতোয়া২৭ শে জুন, ২০১০ বিকাল ৩:০৬ শেয়ার করুন:
(প্রসঙ্গ কথাআমার লেখা ‘কোরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরিক নয় কি?’ গ্রন্থের প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে সিলেটের প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর, বিয়ানীবাজার, সিলেটের ম্যাগাজিন ‘আল-হিলাল-এ। আমরা প্রথমে এই প্রতিবাদ লিপি পাঠ করবো, অতঃপর বিচার-বিশ্লেষণ করবো হাদিস, কোরআন এবং আকাবিরদের দৃষ্টিতে এই লেখার গ্রহণযোগ্যতা।---------------------------------------------------------------------------------আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসার ফতোয়া
‘কোরআন হাদীসের আলোকে তাবিজাত র্শিক নয় কি?’বই প্রসঙ্গে কিছু কথাইবনে তায়্যিব
গত কয়েকদিন আগে বিয়ানীবাজার গিয়েছিলাম। লাইব্রেরীর থাকে রাখা একটি বই হঠাৎ আমার নজর কাড়লো। হাতে নিয়ে দেখলাম বইটির নাম ‘কোনআন হাদীসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?’ ঐ ছোট্ট পুস্তিকাটির লেখক সৈয়দ মবনু। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বইটি পড়ে ফেলাম। লেখক কোরআন হাদীসের কিছু ব্যাখ্যা সাপে আয়াত ও হাদীস দ্বারা সব ধরনের তাবিজাতকে শিরক বলার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।মূলত: সবধরনের তাবিজাত শিরক কি শিরক নয়, এ মতানৈক্যের বীজ সর্বপ্রথম সালাফী তথা আহলে হাদীসরাই বপন করে। সালাফীরা স্বভাবজাত উগ্রতা অনুযায়ী অন্যান্য বিষয়ের মতো তাবিজাতের ব্যাপারেও বেঁকে বসে। অত্যন্ত নির্বাকভাবে তাবিজাত শিরক বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।উক্ত বইয়ের লেখক আপন বইয়ের এক স্থান লিখেন- ‘তাবিজ সম্পর্কে ইসলামের রায় কি? তা আমরা অনেকেই জানিনা। বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় এ সম্পর্কে বিভিন্ন বই প্রকাশিত হলেও আমাদের বাংলাদেশী আলেম সমাজ রহস্যজনক নীরবতা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন।’ অতঃপর তাবিজাতের পারিভাষিক ব্যাখ্যা, তাবিজাত শিরক হওয়ার দলিল সবকিছু আল্লামা আলী বিন নকী আল-উলয়ানী রচিত ‘ আকীদার মানদন্ডে তাবিজাত’ বই থেকে গ্রহণ করেছেন। আল্লামা আলী বিন নকী একজন বিখ্যাত সালাফী আলিম। লেখকের প্রতি আমার যেথেষ্ট আস্থা আছে। আমি তার বিভিন্ন বিপ্লবী রচনাবলীর একজন ভক্তপাঠকও বটে। কিন্তু তাবিজাতের ব্যাপারে আমার মনে হয় লেখক বর্তমান যুগের সবচে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ সালাফীদের চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছেন। সাধারণভাবে সবধরনের তাবিজাতকে শিরক বলা সালাফীদের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। আমার আশ্চর্য লাগে শুধুমাত্র তাবিজাত শিরক হওয়ার পরে হাদিসগুলো ভাসলো, কিন্তু লেখকের চোখে তাবিজ বৈধ হওয়ার দলীলগুলো ভাসলনা। আলোচ্য জবাবমূলক প্রবন্ধে প্রথমে তাবিজাত বৈধ হওয়ার পরে দলীলগুলো আমি পেশ করার চেষ্টা করব। অতঃপর তার পেশকৃত দলীলগুলোর জবাব দেব ইনশাল্লাহ।তাবিজ জায়েজ হওয়ার পক্ষে আহলুস্সুন্নাহ ওয়ালা জামাতের দলীল :আহলুস সুন্নাহ ওয়ালা জামাতের মতে কুরআনে কারীমের আয়াত, আল্লাহর নাম, দুয়ায়ে মানকুলা ইত্যাদি দ্বারা তাবিজ দেয়া জায়েজ। তবে শর্ত হল তাবিজের মধ্যে নিজস্ব মতা আছে মনে করে তার উপর ভরসা না করা। তাছাড়া কুফুরী কালাম দ্বারা তাবিজ দেয়া বা অর্থ জানা যায়না এমন কালাম দ্বারা তাবিজ দেয়া জায়েজ নয়। (আহসানুল ফাতওয়া, খন্ড ৮, পৃঃ ২৫৫)। তাবিজ জায়েজ হওয়ার পে অসংখ্য দলীল রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা গেল। ইমাম আবু বাকর ইবনে আবী শাইবাহ ‘মুনান্নাফ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা ও তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন ঘুম অবস্থায় ঘাবড়িয়ে উঠে, সে যেন ******** দো’আটি পাঠ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের তা শিক্ষা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন। এই হাদীসটি ইমাম আবূদাউদ (রাহ.) তাঁর সুনানে আবূ দাউদের কিতাবু-তিব্বের **** অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল-তাবিজ দেয়া জায়েজ। যদি শিরক হত তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) এর মত বিখ্যাত বুযুর্গ সাহাবী তাবীজ লিখে ছোট ছোট শিশুদের গলায় লটকিয়ে দিতেন না। বিধায় কোন হাদীস পেলেই তার ব্যাখ্যা, মর্মার্থ, প্রয়োগ স্থল না বুঝে কোন কিছুর ব্যাপারে শিরকের সার্টিফিকেট লাগানো আদৌ ঠিক নয়।ঃ ‘ইবনে আবী শাইবাহ মুজাহিদ (রাহ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ (রাহ.) লোকদের জন্য তাবিজ লিখে তাদের গলায় লটকিয়ে দিতেন। এ মত তিনি আবু জাফর, মুহাম্মদবিন সীরিন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর এবং যাহহাক প্রমুখ থেকে লটকানো, অথবা হাতে বাঁকানো বৈধ মনে করতেন।’উপরে যেসব তাবিয়ীর কথা বলা হলো তারা বিখ্যাত সর্বজন অনুসৃত। এসব তাবিয়ীদের থেকেও কি শিরকের কল্পনা করা যায়? না এসব দুনিয়া বিখ্যাক মুহাদ্দিস তাবিয়ীগণ লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত হাদীসগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন?ঃ আয়িশা (রা.) বলেন, বিপদ আসার পর যা লটকানো হয় তা তামীমা (অর্থাৎ নাজায়েজ তাবীজ) এর অন্তর্ভূক্ত নয়।(৪) সর্বজন মান্য বিশেষত: সালাফিরা যার পদে পদে অনুসরণ করে সেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এর দৃষ্টিতেও তাবিজ-কবচ বৈধ। তিনি ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়ার ১৯নং খন্ডের ৬৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেন, বিপগ্রস্থ বা অসুস্থ লোকদের জন্য কালি দ্বারা আল্লাহর কিতাব লিখে তাবিজ দেয়া এবং ধুয়ে পান করানো জায়িজ।উক্ত আলোচনার শেষদিকে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) তাবিজাত বৈধ হওয়ার পক্ষে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর একটি আছর পেশ করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) কাগজের টুকরায় তাবিজ লিখে দিতেন, তা সন্তানসম্ভবা নারীদের বাহুতে বেঁধে দেয়া হত।(৫) হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ, আল্লামা শামী (রাহ.) লিখেন, নাজায়িজ তাবিজ হল ঐ সব তাবিজ যা কুরআন বহির্ভূত। (রাদ্দুল মুহতার, খন্ড ৫, পৃ: ২৩২)। অতপর তিনি আরোও লিখেন, কুরআনে কারীম দ্বারা অথবা আল্লাহর নাম দ্বারা তাবিজ লিখলে কোন অসুবিধা নেই। (রাদ্দুল মুহতার, খন্ড ৬, পৃ:৩৩৬)। তাছাড়া আল-মুজামুল ওসীত, আল-কামূসুল ওজীয, মিসবাহুল লুগাত, আল-মানার ইত্যাদি প্রামান্য আরবী অভিধাগুলোতে
শব্দের অর্থ বলা হয়েছেন মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ। যদি শব্দের অর্থ তাবিজ মানা যায় তাহলে তাবিজ বৈধ হওয়ার পে মারফু হাদীসের অভাব হবেনা। কারণ, অসখ্য হাদীসে আল্লাহর রাসূল বলেছেন ***** জায়েজ। আহসানুল ফাতাওয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, আবজাদ সংখ্যা দ্বারাও তাবিজ লিখা বৈধ। কারণ, এসব সংখ্যার নির্ধাররিত অর্থ জানা সম্ভব আছে। আরো বহুত দলীল আছে। স্থানাভাবে উল্লেখ করা গেল না। হ্যাঁ এটাকে সকলেই স্বীকার করেন যে, তাবিজকে পেশা বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ খুব সম্মানজনক নয়। তাবিজাতের পেশা সম্মান জনক না হওয়ার দরুনই অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম তা থেকে পরহেয করেন, এজন্য নয় যে তাবিজাত শিরক।
লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত দলীলসমূহের জবাব ঃলেখক বিখ্যাত সালাফী আলিম আল্লামা উলয়ানীর অনুকরণে ইত্যাদি আয়াত দ্বারা তাবিজাতকে শিরক সাব্যস্থ করার চেষ্টা করেছেন। আসলে এসব আয়াত তাবিজ নাজায়িজ হওয়ার পে দলীল দেয়া সম্পূর্ণ হাস্যকর ও শিশুসূলভ কান্ড। যারা তাবিজ কবচকে বৈধ বলেছেন তারা তো ঢালাওভাবে তাবিজকে বৈধ বলেননি। বরং তারাও তো বলেছেন তাবিজের উপর ভরসা চলবেনা।তাবিজের নিজস্ব কোন প্রভাব নেই। রোগ থেকে মুক্তিদানকারী একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। তাবিজ ওসীলা মাত্র। তাবিজকে শুধুমাত্র ওসীলা হিসেবে গ্রহণ করা যদি শিরক হয় তাহলে বলতে হবে বৈধ পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণসহ সবধরনের ওসীলা শিরক। তা ছাড়া শুধুমাত্র তাবিজ কেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেকোন কিছুর উপর ভরসা করা শিরক। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাবিজ গ্রহণ করে তাহলে তা শিরক হতে যাবে কেন? এসব আয়াতের ভিত্তিতে ঢালাওভাবে সবধরনের তাবিজকে শিরক বলা কি স্থুল জ্ঞানের পরিচায়ক নয়? লেখক তাবিজাত শিরক হওয়ার পক্ষে ৫ খানা হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। সবগুলো হাদীসের ইজমালী জবাব হলো- আলোচ্য হাদীসসমূহে ঐসব তাবিজ কবচকে শিরক বলা হয়েছে যার মধ্যে শিরকী কালাম থাকবে। অথবা এসব হাদীস দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, তাবিজের নিজস্ব মতা আছে বলে বিশ্বাস করা, তাবিজই একমাত্র মুক্তিদানকারী ইত্যাদি ধারণার বশীভূত হয়ে তাবিজ ব্যবহার করা শিরক। এসব হাদীসে এ ব্যাখ্যা করতে আমরা বাধ্য। কারণ, বিভিন্ন জলীলুল্ কদর সাহাবী ও তাবিয়ীকে মুশরিক বলতে হবে। সকল মুহাদ্দিসীনে কিরাম তাওয়াক্কুল বিরোধী বলে উলেখ করেছেন। সেসব হাদীসের উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লেখকের দলীর হিসেবে পেশকৃত প্রথম হাদীস (অর্থাৎ ঝাড়ফুঁক, তাবিজাবলী এবং ডোরা সূতা বাঁধা শিরক) এর ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ফক্বীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা শাওকানী (রাহ তাঁর ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে বলেছেন। ‘তামীমা’ রাকী এবং তাওলাকে শিরক বলা হয়েছে এ কারণে যে, জাহিলী লোকেরা মনে করত এসবের মধ্যে নিজস্ব প্রভাব রয়েছে।’ বুঝা গেল আমভাবে সবধরনের তাবিজ শিরক নয়, বরং যে এ কথা বিশ্বাস করবে যে, তাবিজের নিজস্ব মতা রয়েছে, তার জন্য তাবিজ ব্যবহার করা শিরক। তাছাড়া উক্ত হাদীসের একটা শব্দের দিকে নযর দেয়ার মতো। লেখক আপন বইয়ের স্থানে স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, তাবিজাত শিরক হলেও ঝাড়ফুঁক বৈধ। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসে তো ঝাড়ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে। তাহলে ঝাড়ফুঁক বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা দেয়া হবে তাবিজাত বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রেও সে ব্যাখ্যা প্রজোয্য হবে।আসল কথা হল, যেভাবে সকল ঝাড়ফুঁক শিরক নয় সেভাবে সকল তাবীজ কবজ শিরক নয়। হ্যাঁ, কুফরী কালাম দ্বারা রচিত তাবীজ শিরক। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রাহ.) যেসব হাদীসে তাবিজকে শিরক ও তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেব হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন ‘এসব হাদিসের মধ্যে তামিমা দ্বারা মুরাদ হল জাহিলী যুগের তামীমা বা তাবিজ-কবজ। যেসব তাবিজ আল্লাহর নাম এবং আল্লাহর কালাম দ্বারা লিখিত সেসব তাবিজ আলোচ্য হাদীসের অর্ন্তভূক্ত নয়। বরং এ জাতীয় তাবীজ মুস্তাহাব ও বরকতের কারণ। (মিরক্বাত খন্ড নং ৮, পঃ নং ৩২২)আল্লামা শামী (রাহ বলেছেন ‘আলোচ্য হাদীসগুলোর মধ্যে যেসব তাবিজকে শিরক বলা হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য হল কোরআন ছাড়া অন্য কোন শিরকী কালাম দ্বারা তাবিজ লেখা। শুধুমাত্র কোন হাদীস পেয়ে গেলেই নিজের পকেট থেকে ব্যাখ্যা না করে মুহাদ্দিসীনে ক্বিরাম ও ফুক্বাহায়ে ক্বিরাম যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা সিরাতে মুসতাক্বীম থেকে ছিটকে পড়ার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। লেখক যেসব হাদীসকে দলিল হিসাবে গ্রহণ করেছেন সেসবের তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ফুকাহায়ে ক্বিরাম যে ব্যাখ্যা দেননি বরং তারা অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কারণ, তারা বুঝেছিলেন যে লেখকের মত ধুম ফতোয়াবাজী করলে অনেক সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীনে ইযামকে মুশরিক বলতে হবে। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম ইসলাম গ্রহণের পর সব ধরণের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। আচ্ছা বলুন তো! আমরা আপনার ব্যাখ্যা মানব না মোল্লা আলী ক্বারী, ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল্লামা শাওকানী, আল্লামা শামী প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যা মানবো? তারা তো ঢালাওভাবে সবধরনের তাবিজকে শিরক বলেন নি বরং বলেছেন লাভ ও রোগ মুক্তির উপায়। তাছাড়া কিয়াছও তাবিজের বৈধতার পক্ষে কারণ, সকল উলামায়ে কিরাম একথার ব্যাপারে একমত যে, আয়াতে কুরআনী, দুয়ায়ে মাছুরা ইত্যাদি দ্বারা ঝাড়ফুঁক জায়িজ, তাহলে আয়াতে কুরআন বা দুয়ায়ে মাছুরা দ্বারা তাবিজ লিখে গলায় লটকালে দোষ কোথায়?আগেই বলেছি কুরআন হাদীস দ্বারা তাবিজের বৈধতার পে অসংখ্য দলীল থাকা সত্ত্বেও তা লেখকের নজর কাড়তে সম হয়নাই। শুধুমাত্র হযরত আয়িশা (রা এর একটি হাদীস তার নজরে পড়েছিল। যে হাদীসে নবী পত্নী আয়িশা (রা.) বলেছিলেন, ‘বালা মুসীবত আসার পর যা লটকানো হয় তা তামীমা (তথা যে সব তাবীজকে শিরক বলা হয়েছে।) সে সবের অন্তর্ভূক্ত নয়। এই হাদীসের জবাব দিতে গিয়ে লেখক সম্পূর্ণ বিষয়টাকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছন। কারণ, তিনি উক্ত হাদীসে আয়েশার জবাব দিতে গিয়ে বলেন, হযরত আয়েশা (রা.) আত-তামাইমু দ্বারা ব্যাপকভাবে সকল তাবিজ বুঝান নি। বরং শুধু মাত্র কুরআনের আয়াতের শিরক নয়কি? বইয়ের স্থানে স্থানে ব্যাপকভাবে সবধরনের তাবিজকে শিরক বলা হয়েছে কোন ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই। এমনকি এক জায়গায় তিনি লিখেন ‘মাজারে গিয়ে কোন কিছু প্রার্থনা করা যেমন পাপ। তেমনি তাবিজের মাধ্যমে কিছু প্রাপ্তির আশাও পাপ’। তাই হাদীসের আয়িশার তিনি যে জবাব দিয়েছেন তা কি স্ববিরোধী হলনা। আর যদি আমরা মেনে নেই যে, লেখকের মতেও সবধরণের তাবিজ শিরক নয়, বরং কেবলমাত্র কুফরী কালাম দ্বারা লিখিত তাবিজ শিরক। তাহলে প্রশ্ন, লেখক বাঙ্গালী আলিমদেরকে এতো বিষোদগার করলেন কেন? কেন উলামায়ে কেরামের গায়ে শিরকের কালিমা লেপন করলেন? কেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমাদের আকাবিরকে হেয় প্রতিপন্ন করলেন? আলিম সমাজ তো ঢালাওভাবে সব ধরনের তাবিজকে বৈধ বলেন না। তবে আসলে লেখকের মূল মাকসুদ হল সব ধরনের তাবিজাতকে শিরক সাব্যস্ত করা। যা তার বইয়ের বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। আমি লেখককে অনুরোধ করব, আপনি আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করুন, সালাফীদের অন্ধ অনুকরণে অবৈধ ফতোয়াবাজী করে আমাদের আকাবিরদের চরিত্রে শিরকের কালিমা লেপন করা কতটুকু ঠিক হল?

-----------------------------------------------------

তাবিজ-কবজ বৈধ করতে আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসার বক্তব্যের উত্তর


আমার লেখা ‘কোরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরিক নয় কি? গ্রন্থের প্রতিবাদে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর, বিয়ানীবাজার, সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘আল-হিলাল’-ম্যাগাজিনে জনৈক ইবনে তায়্যিব কিছু লিখেছেন কিংবা লিখতে চেষ্টা করেছেন। এই সংবাদ কিছু বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছলে আমি সত্যই কিছুটা আগ্রহি হয়ে উঠি ম্যাগাজিনটি সংগ্রহের জন্য। ‘কোরআন-হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি’ লেখাটি আমি প্রথমে লিখেছিলাম লন্ডনের সাপ্তাহিক নতুনদিন পত্রিকায়। অতঃপর তা দুই হাজার খ্রিস্টাব্দের ঈদুল আযহায় সিলেট থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়। দেশ-বিদেশে এই ছোট্ট পুস্তিকাটি বেশ আলোচিত-সমালোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে যাদের পেশা তাবিজাত, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন আমার উপর। নামে-বেনামে অনেকে গালি-গালাজও করেছেন। বাংলাদেশের আলেম সমাজের সাথে আমার পরিবারের গভীর সম্পর্ক জেনে কেউ কেউ দল বেঁধে বড় বড় আলেমদের কাছেও গিয়েছেন এই বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে। হযরতে উলামায়ে কেরামদের একেক জনের একেক ধরণের বক্তব্য এসেছে এই বিষয়ে আমার সামনে। বিশেষ করে দরগাহে হযরত শাহ জালাল (র.) এর মসজিদের সাবেক ইমাম ও জামেয়া ক্বাসেমূল উলুম দরগাহে হযরত শাহ জালাল (র.) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা আকবর আলী (র.) আর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব শায়খুল হাদিস মাওলানা উবায়দুল হক (র.) সরাসরি আমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছেন। হযরত ইমাম সাহেব ছিলেন আমার মুর্শিদ, তিনি যখন এই বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা শুরু করেছিলেন তখন সত্যই আমি আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা জানি তিনি নিজেও মানুষকে তাবিজ দিতেন। কিন্তু হুজুর আমার বক্তব্য শোনে মুচকি হাসলেন এবং বললেন-‘হযরত রাসুল (স.)এর সুন্নতে নেই। আকাবিরগণ দিতেন মূর্খ মানুষ আর বাচ্চাদেরকে। মানুষ মানে না তাই দিতে হয়।’ আর খতিব সাহেব হুজুর বললেন-‘আকাবিরগণ করেছেন সত্য, কিন্তু হাদিসে রাসুল (স.) এ এসবের কোন বৈধতা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তবে আমরা এই বিষয়ে নিরবতা প্রদর্শন করি হযরত আকাবিরদের সম্মানার্থে।’ এই দুই বুজুর্গের কথা আমাকে বেশ নাড়িয়ে গেলো। আমি বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন ভেবেছি। এ ছাড়া অনেক এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে, দলবদ্ধ হয়ে। অনেকে বলেছেন অনেক কথা। আর তাবিজ ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগের বক্তব্যই ছিলো এমন-তুমি মিয়া মার অযোগ্য পাপ করেছো এই বই লিখে। আমি তাদেরকে বলেছি-কলমের উত্তর কলম দিয়ে দিতে হয়, মুখে নয়। নসের (কোরআন-হাদিসের) উত্তর নস (কোরআন-হাদিস) দিয়ে দিতে হয়, অন্য কিছু দিয়ে নয়। কিন্তু পদ্ধতিগত উত্তর তেমন একটা আসেনি। মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান লন্ডন সফরে গেলে আমার তাবিজের পরে বন্ধুরা তাকে জড়িয়ে ধরেন কিছু একটা লেখার জন্য। দুই হাজার খ্রিস্টাব্দের ৯ আগষ্ট মাওলানা মুহিউদ্দিন খান লিখলেন লন্ডনের ইসলামিক সমাচার ম্যাগাজিনে। মাসিক মদিনার সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মুহিউদ্দিন খান আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তবে রাজনৈতিক ময়দানেও তাঁর বেশ সুনাম আছে। সাহিত্যিক হিসেবে অনেকে তাকে মনে করলেও মৌলিক সাহিত্যে তাঁর খুব একটা কর্ম নেই। তবে অনেক গবেষণাধর্মী গ্রন্থের সম্পাদনা করে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই বাংলার মুসলমানদের মনে এবং ইতিহাসে শ্রদ্ধার সাথে অমর হয়ে থাকবেন। আমি তাঁর প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখে বলবো, তাবিজের পে তিনি যে দলিলসমূহ দিয়েছিলেন তা বেশ দুর্বল ছিলো। তখন আমি এই দুর্বল দলিলগুলোর উত্তরও দিয়েছিলাম ২৫ অক্টোবর এবং ৮ নভেম্বর দুই হাজারে প্রকাশিত ইসলামিক সমাচারের দুই সংখ্যায়। খান সাহেব তখন লন্ডনেই ছিলেন। বার্মিংহামের আস্টন এলাকায় এক অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে আমার দেখা হলে তিনি আমার লেখা পড়েছেন বলে জানালেন। সেই অনুষ্ঠানে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) সহ আরো বেশ কিছু উলামা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সাথে এরপর আমার অনেক কথা হয়েছে এবং তিনি কেনো লিখেছেন, তাও সেই আলোচনায় স্থান পেয়েছিলো। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান একজন বড় মনের মানুষ,তিনি তাঁর সম্পূর্ণ লেখায় আমার বক্তব্যের উত্তর দিতে চেষ্টা করলেও একবারও আকারে-ইঙ্গিতে আমার দিকে ইশারা পর্যন্ত করেননি। শুধু তাই নয়, পরবর্তিতে অনেকের সাথেই তিনি আমার প্রসংশা করেছেন। আর তাঁর ছেলে মর্তুজা ভাই’তো আমার ঘনিষ্টদের একজন। সে যাই হোক, মূল বিষয়ে আসা প্রয়োজন। যখন শোনলাম সিলেটের জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে আবার এই বিষয়ে কেউ একজন নাড়া দিয়েছেন, কিছু লিখেছেন, তখন ভাবলাম-হয়তো এখন কিছু সঠিক তথ্য পাবো, তাবিজের পে বিশুদ্ধ দলিল পাবো। আমি তাবিজের বিরুদ্ধে কোরআন-হাদিসের যে দলিলগুলো উপস্থাপন করেছি তা যদি কেউ ভুল প্রমাণিত করতে পারেন তাবে আমি তাওবানামা লিখবো না কেনো? আমিতো এসব লিখছি না নিজের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থে, আমি লিখছি একান্ত দ্বীনি কারণে। যদি আমার কোন একটি কথাও দ্বীনের মখালিফ হয়, তবে আমি জেনে-বুঝে এই ভুলের উপর ইস্তেক্বামত থাকতে পারি না, যদি সত্যই আমার ভেতরে একবিন্দু ঈমান থাকে। ঈমানের তাকিদে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে উঠি ‘আল-হিলাল’ ম্যাগাজিন সংগ্রহের জন্য। কিন্তু সিলেট শহরে পাওয়া গেলো না। শেষ পর্যন্ত রুহুল আমীন নগরী নামক একজন তরুণ আলেম আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর থেকে এনে এই ম্যাগাজিনখানা দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞ করলেন। ধন্যবাদ তাকে। তবে সত্যই আমি যেমন ভেবে ছিলাম তেমন তেইশতম সংখ্যা ‘আল-হিলাল’ ২০০৭-৮ এ ‘কোরআন হাদীসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি? বই প্রসঙ্গে কিছু কথা’ শিরোনামের লেখাটি শক্তিশালি দলিলের ভিত্তিতে হয়নি বলে খুব হতাশ হয়েছি। অবশ্য লেখাটি মাসিক মাদিনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান-এর লেখা থেকে কিছুটা তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু লেখক আমাকে আশাহত করলেন ‘ধান ভাঙতে শিবের গীত গেয়ে’। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে লেখক পলাতক, লেখক নিজেই সন্দিহান নিজের দলিলগুলোর ওপর। ইবনে তায়্যিব লেখকের আসল নাম কি ‘তাখাল্লুস’ বা ‘কুনিয়াত’ তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমার অপরিচিত বন্ধু ইবনে তায়্যিব এক নিঃশ্বাসে ‘কোরআন-হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?’ বইখানা পড়ে লিখিত উত্তর দিতে যে একটা চেষ্টা করেছেন, সেজন্য তাকে বিশেষ ধন্যবাদ। আমার মূল গ্রন্থ ‘ কোরআন-হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি? এবং তাবিজের পক্ষে মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের লেখা ও আমার উত্তর পাঠের পর আশা করি একজন পাঠক ইবনে তায়্যিবের লেখার উত্তর পেয়ে যাবেন। তবে তাঁর লেখায় কিছু নতুন তথ্য এবং আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উপস্থাপিত হয়েছে বলে পৃথক উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করি। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা বন্ধু ইবনে তায়্যিবের তাবিজের পরে যুক্তিগুলোকে-আতিউল্লাহ, আতিউররাসুল এবং উলিল আমরের ভিত্তিতে বিবেচনা করি। স্মরণ রাখতে হবে, এটা ব্যক্তিগত কোন সম্পত্তি বিষয়ক আলোচনা নয়, তিনিও যা করেছেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস তা দ্বীনি স্বার্থে। না, এখানে পক্ষ-বিপক্ষের কোন বিষয় নয়। বিষয়টা হলো-জানা এবং নাজানার। যে কোন ভুল কর্ম যখন প্রসিদ্ধ হয়ে যায়, তখন অনেকের মনে তা যে ভুল, একথাও থাকে না। ইসলামি কর্মে ভুল-শুদ্ধের নির্ণয় হয় আতিউল্লা, আতিউর রাসুল এবং উলিল আমরের ভিত্তিতে। ‘আতিউল্লা’ মানে আল্লাহর আনুগত্য এবং ‘আতিউর রাসুল’ মানে রাসুল (স.)এর আনুগত্য, এই কথাতো সবার সামনে স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো উলিল আমর নিয়ে। কারা এই উলিল আমর? মুফাস্সিরিনরা লিখেছেন-উলিল আমর হলেন যাদের জীবন ও কর্ম পূর্ণাঙ্গ কোরআন-হাদিস ভিত্তিক। কোরআনের ভাষায় মুসলমানদের আকাবির তাদেরকেই বলা যাবে যাদেরকে উলিল আমরের ভেতর পাওয়া যাবে। ব্যক্তি বিশেষকে প্রশ্নের মুখোমুখি না করে আমরা যদি উলিল আমরকে তার মূল নীতি অনুসারে বিবেচনা করি, তবে দ্বীনের বেশি উপকার হবে। ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যাবে, কিন্তু ব্যক্তিকে নিয়ে কথা না বলাটাই ভালো। কালামুল্লাহ এবং সুন্নতে রাসুলুল্লাহ আমাদের সামনে থাকতে আমরা কেনো ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্ন করে প্রতিপকে বাধ্য করি ব্যক্তির ত্রুটিসমূহ আলোচনা করার। একজন ব্যক্তি, যিনি দেড় হাজার বছর পরের উম্মত, আমাদের প্রায় সমসাময়িক, তা ছাড়া তিনিও মানুষ, তিনি বড় আলেম হলেও মানবিক দুর্বলতা থাকতেই পারে। বর্তমান সময়ের আকাবিরদের এমন অনেক মানবিক দুর্বল ঘটনা আমাদের সামনে স্পষ্ট আছে, যা আলোচনায় নিয়ে আসা অনুচিত। আমরা আমাদের আকাবিরদের শ্রদ্ধা এবং অনুসরণ অবশ্যই করবো, কিন্তু অনুসরণটা অন্ধভাবে নয়। কোরআন-সুন্নাহের চশমা আমাদের চোখে রাখতে হবে। আমরা অতীতে দেখেছি এবং আজও দেখছি, একই ধারার আকাবিরদের মধ্যেও প্রচন্ড মতানৈক্য থাকে। ইলমি মতানৈক্য মানে একজন আরেকজনকে অস্বীকার কিংবা অসম্মান করা নয়। ‘খেলাফ’ এবং ‘ইখতেলাফ’ এর মধ্যে প্রচুর ব্যবধান রয়েছে। ‘ইখতেলাফ’ হলো পথ ভিন্ন কিন্তু ল্য এক, আর ‘খেলাফ’ হলো পথ এবং ল্য দু’টাই ভিন্ন। আমি আমার আকাবিরদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা জানিয়ে বন্ধু ইবনে তায়্যিবের বক্তব্য সম্পর্কে কিছু কথা বলবো। তবে তাঁর সাথে আমার ‘খেলাফ’ নেই, আছে শুধু ‘ইখতেলাফ’। তিনি আমার সম্পর্কে বলেছেন,‘লেখক কোরআন-হাদিসের কিছু ব্যাখ্যা সাপে আয়াত ও হাদীস দ্বারা সবধরনের তাবিজাতকে শিরক বলার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।’ না বন্ধু, মোটেও অপপ্রয়াস নয়। ‘কিছু ব্যাখ্যা সাপে’ বলে যখন আপনি কথাটা বললেন, তখন যদি আপনি ‘সাপে’ বাদ দিয়ে ‘ব্যাখ্যাগুলো’ দিয়ে দিতেন, তবে আমরা পাঠকেরা হয়তো অনুভব করতে পারতাম, আপনি তাবিজ বৈধ করার অপপ্রয়াস মোটেও চালাননি। তাবিজের পে আপনি ‘আহসানুল ফতোয়া’র আশ্রয় নিয়েছেন। এই গ্রন্থের লেখক আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন আলেম পাকিস্তানের মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)। হযরত মুফতি সাহেব মরহুমের সাথে আমার বেশ কয়েকবারই দেখা হয়েছে পাকিস্তানের করাচি শহরে, তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত দারুল ইফতায়। তিনি আমাদের সময়ের একজন অন্যতম বুজুর্গ আলেম, বিজ্ঞ মুফতি এবং সাহসী বীর ছিলেন। আমার সাথে যখন তাঁর দেখা হয়েছিলো তখন তিনি খুব বৃদ্ধ। কিন্তু কথার ভেতর ছিলো তারুণ্যের প্রজ্জ্বলন। সেই সাাতের পর থেকে আজও মুফতি সাহেবের নাম শুনলে শ্রদ্ধা আসে মনে। অবশ্যই তিনি আমাদের আকাবির ছিলেন। তবে তাঁর সকল ফতোয়া চোখ বন্ধ করে হয়তো আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব নিজেও মানবেন না। আমি যদি কয়েকটি ফতোয়া ‘আহসানুল ফতোয়া’ গ্রন্থ থেকে এখানে আলোচনা করি তবে বিষয়টি দীর্ঘ হয়ে যাবে। পাঠকদের ধৈর্য্যরে কথা বিবেচনা করে শুধু দুটি ফতোয়ার দিকে আমার বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি। ‘আহসানুল ফতোয়া’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (রহ.) ‘ বিত্তশালীদের নিকট আলিমদের অপমান থেকে হেফাজত’ শিরোনামে মাদ্রাসাসমূহের চাঁদা আবেদনের প্রচলিত পদ্ধতি জায়েয নয় বলে যে ফতোয়া দিয়েছেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসা এই ফতোয়া মানতে পারবে না। কারণ, তিনি এখানে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন-‘যারা বিভিন্ন লোকের বাড়িতে গিয়ে, দোকানে গিয়ে কিছু উসুল করার জন্য সীমাহীন অনুরোধ করে, বিশেষত রমজান মাসে দীনি মাদ্রাসাগুলোর প্রতিনিধিদের বিভিন্ন দল পরিলতি হয়, যাদের ভয়ে অধিকাংশ দোকানদার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকেন, এই রকমের চাঁদা করার পদ্ধতি সুনিশ্চিতরূপে না জায়েয। মুফতি সাহেবের স্পষ্ট বক্তব্য-‘ দীনি কাজ হবে অমুখাপেক্ষি। অমুখাপেক্ষি যতটুকু অর্থের ব্যবস্থা হয় ততটুকু কাজকে যথেষ্ট মনে করতে হবে। আর যদি চাঁদা করতেই হয় তবে সাধারণ সম্বোধনের অবকাশ রয়েছে, বিশেষ সম্বোধনের মোটেও অনুমতি নেই। যদি সাধারণ সম্বোধনের ক্ষেত্রে এমন হয় যে, বিশেষ কোন ব্যক্তি এখানে থাকেন, আর তিনি কিছু অর্থ না দেওয়াতে সংকোচ অনুভব করেন, তাবে তাও নাজায়েয। বিশেষ সম্বোধনে অধিক কাতরতা এবং মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা জায়েয নয় বরং অমুখাপেক্ষিতার সাথে ব্যয়ের খ্যাত প্রকাশ করেই কান্ত হওয়া উচিৎ। বিশেষ মাহফিল কিংবা ওয়াজ মাহফিল করে যে মাদ্রাসাসমূহের চাঁদা উঠানো হয়, এই পদ্ধতিকে মুফতি সাহেব নিকৃষ্টতম নাজায়েয এবং হারাম ঘোষণা করেছেন।’ প্রিয় পাঠক ‘আহসানুল ফতোয়া’ মূলত উর্দু ভাষায় হলেও তা এখন বাংলায় অনুবাদকৃত বাজারে পাওয়া যায়। মাদ্রাসার চাঁদা বিষয়ক ফতোয়া প্রথম খন্ডের বাংলা অনুবাদে ৫৬৫ পৃষ্টা থেকে ৫৮৮ পৃষ্টা পর্যন্ত বাংলাভাষী যে কোন পাঠক দেখতে পারেন। আমরা জানি না,বন্ধু ইবনে তায়্যিব এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর কিংবা আল-হিলালের প্রকাশকেরা মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)এর এই ফতোয়ার সাথে কতটুকু ঐক্যমতে আসবেন? আল-হিলাল যে সংখ্যায় তাবিজের পে বন্ধু ইবনে তায়্যিব লিখেছেন, আহসানুল ফতোয়াকে সামনে রাখলে এই ম্যাগাজিনের অর্থযোগান পদ্ধতিটা কতটুকু বৈধ হবে? এই প্রশ্ন পাঠকের মনে জাগতেই পারে। কারণ, ম্যাগাজিনের প্রিন্টার লাইনে লেখা আছে লন্ডন প্রবাসী আইনুদ্দীন পীরের অর্থায়নে এই ম্যাগাজিন প্রকাশিত। এই ভাবে ম্যাগাজিনের দেহে দাতার নাম লিখে দেওয়াটা কতটুকু বৈধ? তা একজন পাঠক আহসানুল ফতোয়ার প্রথম খন্ড পড়লে বুঝতে অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া এই আইনুদ্দিন পীর কে? বিশেষ সূত্রে জানতে পারি, এই পির সাহেব লন্ডনে তাবিজ ব্যবসার সাথে জড়িত এবং তিনি শুধু এই লেখার জন্যই আল-হিলাল ম্যাগাজিনের অর্থায়ন করেছেন। এই কথার সত্য-মিথ্যা আল্লাহ ভালো জানেন। সে যাই হোক, বন্ধু ইবনে তায়্যিব যখন ‘ আল-হিলাল’ ২০০৭-৮ এ তাঁর ‘কোরআন হাদীসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি? বই প্রসঙ্গে কিছু কথা’ শিরোনামের লেখাটিতে সালাফীদের তাবিজ বিরোধী অভিযানের বর্ণনা দিয়ে আমার প্রতি যথেষ্ট আস্থার কথা বলে লিখেন-‘কিন্তু তাবিজাতের ব্যাপারে আমার মনে হয় লেখক বর্তমান যুগের সবচে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ সালাফীদের চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছেন।’ তখন আমরা দেখি এখানেও ‘আহসানুল ফতোয়া’র সাথে বন্ধু ইবনে তায়্যিবের মতানৈক্য। তিনি আহলে হাদীস বা সালাফীদেরকে বলেছেন ‘যুগের সবচে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ’, আর মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.) তাদেরকে আহলে হক বলে বর্ণনা করেছেন। মুফতি সাহেবের বক্তব্য-‘ প্রায় দ্বিতীয় তৃতীয় শতাব্দী হিজরীতে আহলে হকের মাঝে শাখাগত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের মতপার্থক্যের কারণে ৫টি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ মাযহাব চতুষ্টয় ও মাযহাবে আহলে হাদীস। সে যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এই পাঁচটি পদ্ধতিতে হক সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হয়।’ ( আহসানুল ফতোয়া, প্রথম খন্ড, মওদূদী মাযহাব অধ্যায়)। আমি ব্যক্তিগতভাবে সালাফি বা আহলে হাদিস মাযহাবের লোক নয়, মাসআলা-মাসায়েলের দিকে আমি মাযহাব হিসেবে সম্পূর্ণ হানাফি। কোথায় থেকে কী ভাবে তাবিজাতের সূত্র অনুসন্ধান শুরু করি, তা আমি আমার মূল গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছি। সালাফীদের বিভিন্ন কর্মের সাথে আমার নিজেরও যুক্তিগত বেশ মতানৈক্য আছে। এই মতানৈক্য খেলাফ নয়, ইখতেলাফ। আর ইখতেলাফটা মাসআলাগত। এই এখতেলাফের কারণেইতো আমি হানাফি মাযহাবকে অনুসরণ করি। আমি এতটুকু হানাফি, যতটুকু ইমাম আজম আবু হানিফা (র.) আমাকে তকলিদ করতে বলেছেন। আহসানুল ফতোয়ার লেখক মুফতি রাশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)র মতো আমিও আহলে হাদিস গ্রুপকে পৃথক একটি মাযহাব মনে করি এবং এই মাযহাবটিও আহলে হক। হানাফিদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে, তেমনি আহলে হাদিসদের মধ্যেও বিভিন্ন গ্রুপ আছে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন বিষয়ে প্রচণ্ড ‘ইখতেলাফ’ রয়েছে। এবিষয়ে এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বন্ধু ইবনে তায়্যিব সালাফিদের উগ্রতা আলোচনা করতে গিয়ে প্রকৃতপে নিজেই যখন বেশ উগ্র হয়ে তাদেরকে ‘যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ’ বলছেন, তখন তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন-এই বাতিলদের পিছনে কি নামাজ জায়েজ হবে? কা’বা শরিফ এবং মসজিদে নব্বী সহ মক্কা-মদিনার বেশিরভাগ ইমামতো এই আহলে হাদিস মাযহাবের আলেমরাই। দু’চারজন অন্যান্য মাযহাবেরও আছেন। বন্ধুবর, যেহেতু আপনি হানাফি মাযহাবের লোক, তাই যে কোন ফতোয়া দেওয়ার আগে কমপে হানাফি মাযহাবের উসূলগুলো দেখে নিলে ভালো হয়। আপনার অভিযোগ-আমি সালাফিদের অন্ধ অনুকরণ করেছি এবং তাবিজাতের বিরোধী হাদিসগুলো দেখলাম কিন্তু পরে হাদিসগুলো দেখলাম না। আমার লেখা যারা পড়েছেন এবং আগামীতে পড়বেন, তারা সবাই স্বীকার করবেন, এই দুই অভিযোগই অগ্রহণযোগ্য। আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন আমি অধমের প্রতি যথেষ্ট আস্থার কথা এবং সাথে সাথে বলেছেন আপনি আমার রচনাবলীর ভক্তপাঠকও বটে। আমার বিশ্বাস, আপনি এই অধমকে কোথাও অন্ধ অনুকরণে পাবেন না। আর তাবিজাত শিরক হওয়ার হাদিস যেমন আমি দেখেছি, তেমনি প্রচুর খুঁজেছি পরে দলিলসমূহও। প্রকৃত অর্থে পরে দলিল খুঁজতে গিয়েই আমি পেয়েছিলাম বিরুদ্ধের দলিলসমূহ। তাবিজাতের সাথে আমার এমন একটা বন্ধন ছিলো যে, ইচ্ছে করলে এই পেশা অবলম্বন করতে পারতাম। আর এখনও যদি সহীহ হাদিস দ্বারা তাবিজাত হালাল বলে প্রমাণ পাই, তবে আমার নাখুশ হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু মাসিক মদিনার সম্পাদক শ্রদ্ধাভজন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান এবং বন্ধুবর ইবনে তায়্যিব আপনি তাবিজাতের পক্ষে যে দলিলগুলো নিয়ে এসেছেন, তা খুবই দুর্বল এবং উসূলে ফেকাহ, বিশেষ করে হানাফি মাযহাবের ফেকাহসমূহের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। বন্ধু ইবনে তায়্যিব মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)এর ‘ আহসানুল ফতোয়া’র ৮ নম্বার খণ্ডের ২৫৫ নম্বার পৃষ্টা থেকে তাবিজের পক্ষে দলিল দিয়েছেন। তবে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। ‘আহসানুল ফতোয়া’র ৮ নম্বার খণ্ডের বাংলা অনুবাদ এখন পর্যন্ত হয়নি। তাই পাঠককে আমার নিয়ে যেতে হবে উর্দু সংস্করণে। আমরা জানি মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)র কাছে মানুষ বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে যেতো, তিনি এগুলোর উত্তর বলে দিতেন। সেখানে এমনও অনেক ফতোয়া আছে যা তাঁর সারে প্রকাশিত হলেও মূলত তা দিয়েছেন আশপাশের অন্য কেউ। অনেক বাংলাদেশি মুফতি সাহেবানও এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আমাকে এই ক্ষেত্র বিশেষ করে স্মরণ করতে হচ্ছে ফেনির শ্রদ্ধাভাজন মুফতি শহিদুল্লাহ সাহেবের কথা। তিনি দীর্ঘদিন মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)এর ফতোয়া বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সাহিত্যের পাঠক যারা, তারা অবশ্যই বুঝেন একটি গ্রন্থে অনেকগুলো মানুষ কাজ করলে ভাষার ছন্দপতন কোথায় কীভাবে হয়। ‘আহসানুল ফতোয়া’ পাঠে একজন পাঠক স্পষ্ট দেখবেন, এখানে প্রচুর ছন্দপতন আছে। আহসানুল ফতোয়ার ৮ নম্বার খণ্ডের ২৫৫ নম্বার পৃষ্টায় তাবিজ সম্পর্কে কোন ফতোয়া পাঠক পাবেন না। মূলত এই পৃষ্টার শেষের দিকে তাবিজ সম্পর্কে প্রশ্নের সূত্রপাত করা হয়েছে। ‘তাওয়িজ কা হুকুম’ শিরোনামে এই অধ্যায়ের শুরু। এখানে কেউ একজন মুফতি সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলো- ‘কিছু লোক বলেন ‘ রকিয়া’ (ঝাড়-ফুঁক) তো প্রমাণিত কিন্তু ‘ তামিমা’ (তাবিজ) প্রমাণিত নয়, বরং শিরিক, তাই প্রথমটি জায়েয এবং দ্বিতীয়টি জায়েয নয়। প্রকৃত অর্থে তাবিজের কী কোন প্রমাণ নেই? আর যদি থাকে তাবে কী শর্তে এবং কী ভাবে তাবিজ লিখতে হবে? মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)এর উত্তর‘ সহীহ হাদিস দ্বারা রকিয়া (ঝাড়-ফুঁক) এর স্পষ্ট কোন দলিল নেই। আর তিন প্রকারের তামিমা (তাবিজ) সম্পূর্ণ হারাম। ১) টুটকা-যা পিতল, তামা অথবা লোহা ইত্যাদির টুকরা বেঁধে করা হয়।২) এই রকমের তাবিজ যাতে আল্লাহর নাম, কোরআনের আয়াত, দোয়ায়ে মাসুরা নেই, বরং শিরক বাক্য রয়েছে।৩) তাবিজের শক্তি আছে এমন মনে করা, যা জাহেল যুগে মনে করা হতো এবং বর্তমানেও অনেক জাহেল এমনটি মনে করে থাকে।এই তিন অবস্থায় তাবিজ সন্দেহাতীত নাজায়েয, হারাম এবং শিরক। তাবিজের মধ্যে যদি আল্লাহর নাম, কোরআনের আয়াত এবং দোয়ায়ে মাসুরা থাকে তবে তা জায়েজ বলে প্রমাণিত। এগুলোকে নাজায়েজ এবং শিরিক মনে করা জাহালিয়ত। কারণ, এই সব তাবিজে সর্বশক্তিমান আল্লাহকেই মনে করা হয়।এরপর মুফতি সাহেব আবার তাবিজ আর ঝাড়-ফুঁককে পৃথক করে তাবিজের বিরোধীতাকারিদেরকে অনুরোধ করে বলছেন-‘ তাবিজকে শিরক যারা বলেন তাদের উচিৎ শিরকের বর্ণনা এভাবে করা, যাতে ভেতরে শুধু তাবিজ থাকে আর দোয়া, ঔষধ, ঝাড়-ফুঁক বেরিয়ে যায়।’ (পৃষ্টা ২৫৬)। মুফতি সাহেবের এই বক্তব্য থেকেও ‘রকিয়া’ বা ঝাড়-ফুঁকের পক্ষে প্রমাণ হলেও ‘তামিমা’ বা তাবিজের পে কোন দলিল হয় না। অতঃপর মুফতি সাহেব আবার তিনটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন তাবিজ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে-১) লগাতে মাহফূমা (অর্থ বোধগম্য) হওয়া, ২) মাছুর (প্রভাবিত, বর্ণিত, প্রভাবাম্বিত) এবং মনকূল (বর্ণিত, স্থানান্তরিত, অনুবাদিত) হওয়া, ৩) নাফে বিজ-জাত, অর্থাৎ তাবিজের কোন শক্তি আছে এমন বিশ্বাসী না হওয়া। অতঃপর মুফতি সাহেব লিখেছেন-‘গণনার অর দিয়ে তাবিজ লেখাও জায়েজ।’ কোন জিনিষ জায়েয এবং কোন জিনিষ নাজায়েয, তা মুফতি সাহেবদের রায় দেওয়ার বিষয়। আমরা তাদের রায়কে শ্রদ্ধার সাথে মেনে নেবো। কিন্তু তাদের নিজের বক্তব্যেই যদি স্ববিরোধীতা স্পষ্ট হয়ে উঠে, তবে আমাদের সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে উপায় নেই। আহসানুল ফতোয়ায় এমন অনেক স্ববিরোধী বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের সামনে। এটা অবশ্যই মুফতি সাহেবের দুর্বলতা নয়, এটা বিভিন্নজন কর্তৃক ফতোয়া লিপিবদ্ধ করার ফলাফল। তাবিজ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে যে তিন শর্ত দিয়েছেন মুফতি সাহেব, একজন সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারবেন যে, তা দিয়েই প্রমাণিত হয় তাবিজ জায়েয নয়। আর গণনার অরকে আজ পর্যন্ত কোন ভাষা বিজ্ঞানি ‘লগাতে মাহফূমা’ বলেননি। এটা মূলত সাংকেতিক অর। আর মুফতি সাহেব যখন বলেন-এই রকমের তাবিজ শিরক যাতে আল্লাহর নাম, কোরআনের আয়াত, দোয়ায়ে মাসুরা নেই, তখন আমাদের প্রশ্ন জাগে গাণিতিক অরে আল্লাহর নাম, কোরআনের আয়াত, দোয়ায়ে মাসুরা কোথায়? হাজার বার কেউ যদি ৭৮৬ পাঠ করে তবে কি একবার বিসমিল্লাহ পড়ার ফজিলত লাভ করবে? গোয়েন্দাগিরিতে সাংকেতিক অরের প্রয়োজন থাকলেও ইবাদতের ক্ষেত্রে এর কোন গুরুত্ব নেই। তা ছাড়া মুফতি সাহেবের তাবিজ সম্পর্কিত আলোচনায় যে কয়েকটি দলিল পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো হানাফি মাযহাবের প্রসিদ্ধ মুফতি মুল্লা আলি ক্বারি (র.)এর বক্তব্য। আমরা মুফতি সাহেবের লেখা আহসানুল ফতোয়ার ৬৫৮ পৃষ্টায় দেখতে পাই তিনি (‘মিরকাত’-এর পাঁচ নম্বার খণ্ডের ৩২১ নম্বার পৃষ্টার তথ্যসূত্রে) মুল্লা আলী ক্বারীর এই বক্তব্যকে নকল করেছেন যেখানে ক্বারী সাহেব লিখেছেন-‘ হিব্রু কিংবা সমপর্যায়ের অন্য কোন ভাষায় তাবিজ লেখা হারাম, কারণ এতে শিরকের সম্ভাবনা রয়েছে।’ মুল্লা আলি ক্বারি (রহ.)এর এই বক্তব্য থেকে প্রমাণ হয়, আরবি ছাড়া অন্যকোন ভাষায় তাবিজ লেখা জায়েয নয়। মুফতি সাহেবের নিজের এবং মুল্লা আলি ক্বারি (রহ.)-এর বক্তব্য সামনে রাখলেই গণনা দিয়ে তাবিজ লেখার বৈধতা অকার্যকর হয়ে যায়। মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী(রহ.) তাঁর আহসানুল ফতোয়ার তাবিজ বিষয়ক আলোচনার শেষ অংশে কয়েকটি হাদিস এবং কয়েকজনের আরবি উক্তির খণ্ডাংশ বর্ণনা করেছেন। উক্তিগুলোতে শিরকমুক্ত তাবিজগুলোর কিছু বৈধতা পাওয়া গেলেও হাদিসগুলোতে তামিমা বা তাবিজকে জায়েয বলা হয়নি, শুধু শিরকমুক্ত রাকিয়া অর্থাৎ ঝাড়-ফুঁক জায়েজ বলা হয়েছে। সম্মানিত পাঠকদের বিষয়টি বুঝতে নিম্নে আহসানুল ফতোয়ায় উল্লেখিত হাদিসগুলো বর্ণনা করা হলো-হযরত আউফ বিন মালিক আশজয়ি (রা.) বলেন-আমরা জাহিলিয়াতে ঝাড়-ফুঁক করতাম। একদিন হযরত রাসুল (স.)কে জিজ্ঞাস করলাম-এব্যাপারে আপনার রায় কি? তিনি বললেন- তোমরা তোমাদের ঝাড়-ফুঁক আমার সামনে পেশ করো, এতে যদি শিরক না থাকে তবে কোন অসুবিধা নেই।( মুসলিম শরিফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্টা ২২৪)। এই হাদিসে তাবিজ শব্দের কোন উল্লেখ নেই। এখানে ‘রাকা’ এবং ‘ রাকি’ শব্দের উল্লেখ আমরা দেখতে পাই। স্বয়ং আহসানুল ফতোয়ায় ‘রাকিয়া’ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে-দম, আর ‘তামিমা’ শব্দের অর্থ-তাবিজ।(পৃষ্টা ২৫৫, উর্দু সংস্করণ)। ‘দম’ বলা হয় ঝাড়-ফুঁককে।* হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন-হযরত নবি করিম (স.) আমাদেরকে এক অভিযানে প্রেরণ করলে আমরা এক গোত্রে গিয়ে উপস্থিত হই এবং তাদের কাছে থাকার জায়গা চাই। তারা আমাদেরকে থাকার জায়গা দিলো না। অতঃপর তাদের সর্দারকে বিচ্ছু কামড় দিলো। তারা আমাদের কাছে জানতে চাইলো, আমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে বিচ্ছুর কামড়ের ঝাড়-ফুঁক জানে? আমি বললাম-হ্যাঁ! আমি জানি। তবে আমি ততণ পর্যন্ত ঝাড়ফুঁক করবো না যতণ পর্যন্ত তোমরা এর বিনিময়ে একপাল বকরি দেবে না। উত্তরে তারা বললো- আচ্ছা, আমরা তোমাদেরকে ত্রিশটি বকরি দেবো। আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলাম এবং তার ওপর সাতবার সুরা ফাতেহা পড়ে ফুঁক দিলাম।( তিরমিজি, ২ খণ্ড, পৃষ্টা ২৬)। এই হাদিসে ‘ ফাকারা’তু’ শব্দ দিয়ে নিশ্চয় তাবিজ-কবজ বুঝানো হয়নি। ‘ক্বেরাত’ শব্দের অর্থ যে পাঠ, এটা একজন সাধারণ মুসলমানেরও জ্ঞানে আছে। তা ছাড়া এখানে যদি ‘তামিমা’ শব্দও আসতো তবু মনে হয় শরিয়তের সাধারণ বিধানে তাবিজ জায়েয হতো না। শুধু শব্দ দিয়ে যে শরিয়তের বিধান হয় না তা আমরা সবাই জানি। যে কোন হাদিস কিংবা কোরআনের মর্মকথা বুঝার জন্য শাব্দিক অর্থের পাশাপাশি শানে নুজুল বা ইসতেলাহি অর্থ বুঝতে হবে। হযরত আবু সাঈদ কুদরি(রা.) থেকে তিরমিজির এই যে হাদিসটি আহসানুল ফতোয়ার লেখক আমাদেরকে শোনালেন, তা ছিলো মূলত জিহাদের প্রোপট, সফরের অবস্থা এবং তারা ছিলেন তখন আশ্রয়হীন অনেকটা অসহায়। এই যে তিন অবস্থা, এর প্রত্যেকটিতে শরিয়তের বিধান সাধারণ বিধান থেকে প্রচুর ভিন্ন। জিহাদের পথে যে মুজাহিদ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, কিংবা যিনি মুসাফির, তাঁর জন্য এমন অনেক কিছুই হালাল হয়ে যায় যা সাধারণ জীবনে সম্পূর্ণ হারাম। তাই বলছিলাম, যদি এখানে ‘ক্বেরাত’ শব্দ না বলে ‘তামিমা’ বলা হতো, তবু শরিয়তের সাধারণ নিয়মে তাবিজ জায়েয বলা যেতো না, যেহেতু অন্য হাদিসে তাবিজকে শিরক বলা হয়েছে। আর এখানেতো তামিমা বলাই হয়নি। কোরআনের আয়াত কিংবা মাসনুন দোয়া পড়ে ফুঁক দেওয়ার বৈধতা সম্পর্কে যেহেতু হাদিসে স্পষ্ট আছে, তাই কোন মুসলমানের আপত্তি থাকার কথা নয়। মূলকথা হলো বিষয়টিকে পৃথক করে দেখতে হবে। শরিয়তের অনেক বিষয়কে আমরা পৃথক করে না দেখার কারণে অনেক সময় বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, হযরত নবি করিম (স.) হাসান এবং হোসেনের জন্য নিরাপত্তা কামনা করে বলতেন, আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ নামের মাধ্যমে আমি তোমাদের দু’জনের নিরাপত্তা চাচ্ছি প্রত্যেক শয়তান, অনিষ্ট এবং কুদৃষ্টি থেকে। যে ভাবে হযরত ইব্রাহিম (আ.) চাইতেন ইসমাঈল এবং ইসহাকের জন্য।( তিরমিজি শরিফ, পৃষ্টা ২৬, খণ্ড ২)।এই হাদিসেও তামিমা শব্দের কোন উল্লেখ নেই। হযরত নবি (স.) হযরত হাসান এবং হযরত হোসেন (রা.) কে কোন তাবিজ দেননি। দিয়েছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)এর মতো দোয়া। ‘ আউযু কামা কালিমাতুল্লাহ’ বাক্যের অর্থ নিশ্চয় তাবিজ নয়, বরং দোয়া প্রমাণিত হয়। হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, এই দোয়া হযরত নবি করিম (স.) প্রত্যেক সকাল-বিকাল করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন-‘ যা বিপদ আসার পর লটকানো হয় তা ‘ তামিমা’ নয়। ‘ তামিমা’ হচ্ছে যা বিপদ আসার পূর্বে লটকানো হয়।(আত-তারগিব, খণ্ড ৫, পৃষ্টা ২৭১,এই হাদিস বর্ণনা করে হযরত হাকিম (র.) বলেছেন এর সনদ সহীহ)। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- বিপদ আসার পর যা লটকানো হয় তা ‘তামিমা’ নয়।( শহরে মাআনিল আশার, খণ্ড ২, পৃষ্টা ৩২৩)।এই হাদিস সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমি আলোচনা করেছি ‘কোরআন-হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি’ গ্রন্থে। এই হাদিসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে ইসলামের রায় হলো- হযরত আয়েশা (রা.) মুছিবত আসার পর কুরআনের আয়াতের তাবিজ ব্যবহার জায়েজ বলেছেন কিন্তু মুছিবতের পূর্বে ইহা নাজায়েয। হযরত আয়েশা (রা.) (আত-তামাইমু) শব্দ দ্বারা ব্যাপকভাবে সকল তাবিজ বুঝাননি। বরং শুধু কুরআনের আয়াতের তাবিজ বুঝানোই তার উদ্দেশ্য। কারণ, অন্যান্য তাবিজাবলী যে রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে এবং পরে সর্বাবস্থায় শিরকের অন্তর্ভুক্ত তা হযরত আয়েশা (রা.) কাছে অজানা ছিলো না। (ফাতহুল বারী)। যারা হযরত আশেয়া (রা.)-এর উক্তিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, হযরত আয়েশা (রা.) যে কথা বলেছেন তা তাবিজ ব্যবহরের পে কোন দলিল নয়, বরং তা হচ্ছে তাবিজ কি?-এর ব্যাখ্যা। তা ছাড়া যেহেতু ইসলামপূর্ব জাহেল যুগ থেকে তাবিজাতের প্রথা ছিলো, যদি তা বৈধ হতো তবে কুরআন কিংবা হাদিসে স্পষ্ট কিংবা ইঙ্গিতে অনুমতি দেয়া হতো। দেওয়া তো হয়নি, বরং বিরোধীতা স্পষ্টভাবে করা হয়েছে। হাদিসে রাসুল (সা.) যে জিনিসের বিরোধীতা করেছেন আমরা কী ভাবে মনে করবো হযরত আয়েশা (রা.) সেই জিনিসের পে উক্তি দিয়েছেন? হযরত হাফিজ (র.) বলেন- তামিমার বহুবচন তামাইম, তা কবজজাতীয় জিনিস। যা জাহিলিয়াতের সময় মাথার মধ্যে লোকেরা এই ধারণা করে লটকিয়ে রাখতো যে, তা বিপদ-আপদ দূর রাখবে। (ফতহুল বারি, খণ্ড ১০, পৃষ্টা ১৬৬)।হযরত হাফিজ (র.)-এর এই উক্তিও হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মতো তাবিজের পরিচিতি মূলক। এবং তাদের উভয়ের এই উক্তি দিয়ে তাবিজের অবৈধতাই প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে হযরত হাফিজ (র.) এর এই উক্তি দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, তাবিজ-কবজ জাহিলযুগের কর্ম। মুল্লা আলি ক্বারি (র.) বলেন-এবং পবিত্র কোরআনের আয়াত, আল্লাহ পাকের সিফাত এবং নাম, এবং দোয়ায়ে মাসুরাসমূহ এক্ষেত্রে কোন দোষ নেই, বরং তাবিজ হোক অথবা ঝাড়-ফুঁক, তা মুস্তাহাব, তবে তা হিব্র“ অথবা সমপর্যায়ের অন্য কোন ভাষায় লিখা নিষেধ, কারণ তাতে শিরকের সম্ভাবনা আছে। (মিরকাত, খণ্ড ৮, পৃষ্টা ৩২২)।মুল্লা আলি ক্বারি (র.) এর এই বক্তব্য থেকে আমাদের সামনে বেশ কিছু মাসআলা প্রমাণিত হয়। আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব এই আহসানুল ফতোয়া থেকে মুল্লা আলি ক্বারি(র.)এর এই উক্তিকে দলিল করেছেন। যদিও অগণিত সহীহ হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যের সামনে এই উক্তির গুরুত্ব খুব একটা বেশি নয়, কিন্তু আমাদের কাছে মুল্লা আলি ক্বারি (র.)-এর গুরুত্ব প্রচুর। তাই এই উক্তি নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবতে হচ্ছে এবং আমাদেরকে ভাবতে হবে জেনেই আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব এই উক্তিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এখানে ইচ্ছায়Ñঅনিচ্ছায় একটু চালাকি হয়ে গেছে। মুল্লা আলি ক্বারির বক্তব্যকে একসাথে বর্ণনা না করলে মূল বক্তব্য বুঝা যায় না, তাই মনে হয় তিনি তাবিজ-কবজকে বৈধ বলেছেন। আহসানুল ফতোয়ায় এই উক্তির কোন ব্যাখ্যা করেননি মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)। আমরা আগেই বলেছি এই উক্তির মাধ্যমে গণিত দিয়ে তাবিজ লেখা জায়েয নয় প্রমাণিত হয়, যা স্বয়ং আহসানুল ফতোয়ার লেখকের মতের উল্টো। দ্বিতীয়ত আমরা জানি, মুল্লা আলী ক্বারী একজন হানাফি ফক্হি ছিলেন। আর তাঁর বক্তব্য থেকেও প্রমাণিত হয়, ইমাম আবু হানিফার মতো তিনিও মনে করেন- শিরকের পথ বন্ধ করতে এমন সকল আমল বন্ধ করতে হবে যাতে শিরকের সম্ভাবনা আছে। এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, যে মুফতি সাহেবগণ এতোদিন মুল্লা আলী ক্বারী (র.)এর বক্তব্য সামনে এনে তাবিজ-কবজকে বৈধ মনে করতেন, তারা বর্তমান তাবিজের জাহেলিয়াতগুলো বিবেচনা করে মুল্লা আলি ক্বারির এই উক্তির ভিত্তিতে তাবিজকে হারাম করা উচিৎ নয় কি? মুল্লা আলি ক্বারি(র.)-এর সম্পূর্ণ বক্তব্য পড়লে আমরা দেখতে পাই তিনি দীর্ঘ আলোচনা শেষে মূলত এই কথাই বলেছেন-****‘ ওয়াক্বিলা ইউম’না-উ ইযা কানা হুনাকা নাউ’উ ক্বাদহিন ফিত’তাওয়াক্বুলি। অর্থ-যখন তাবিজের কারণে তাওয়াক্কুলে কোন প্রকার ঘাটতি আসবে তখন তা থেকে বারণ করা হবে।’ (প্রাগুক্ত)। মুল্লা আলী ক্বারি (র.)-এর এই বক্তব্যানুসারে আমল না করে আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব যখন তাবিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেন, তখন সত্যই মনে অনেক কিছু প্রশ্ন জাগে, অনেকগুলো সন্দেহের জন্ম দেয়।এরপর আবার বলা হচ্ছে-***তামীমা হলো এই ধরণের তাবিজ যা শিশুদের গলায় দেওয়া হতো, যাতে আল্লাহর নাম, কোরআনের আয়াত, দোয়ায়ে মাছুরা লেখা থাকতো না।(মিরকাত, খণ্ড ৮, পৃষ্টা ৩২২)। এখানেই মসআলা পূর্ণাঙ্গ হলো। আমরা জানতে পারলাম-আল্লাহর নাম এবং দোয়ায়ে মাসুরা ছাড়া যা লিখে শিশুদের গলায় দেওয়া হতো তাকে তামিমা বলে। এখানে তামিমার যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা কোন আলেমই জায়েজ বলছেন না। মোটকথা, মুল্লা আলি ক্বারি(র.)-এর সব কথা এক করলে দেখা যায় তিনি তাবিজের পে নয়। আর বর্তমানে যেভাবে তাবিজের ব্যবসা আর তাবিজের শক্তি মানুষের মনে এবং পত্রিকার বিজ্ঞাপনে, তা যদি মুল্লা আলি ক্বারির যুগে হতো তবে তিনি চূড়ান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে যতটুকু বৈধতা দিয়েছেন তা বর্তমানে সম্পূর্ণ হারাম এবং শিরকই বলতেন। আর হানাফি মাজহাবের উসূল অনুযায়ী তা শিরক ছাড়া অন্য কিছু নয়। মুল্লা আলি ক্বারির মৃত্যু ১০১৪ হিজরিতে। বর্তমানে চলছে ১৪২৮ হিজরি। মধ্যখানে সময়ের ব্যবধান চারশ চৌদ্দ বছরের। বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

ইবনে আবেদিনের মতে- তাবিজে কোন দোষ নেই যদি তাতে কোরআনের আয়াত ও আল্লাহর নাম লিখে দেওয়া হয়।(রাদ্দুল মুহতার, খণ্ড ৬, পৃষ্টা ২২৩)।
‘ইবনে আবেদিন’ নামে খ্যাত ফতোয়ায়ে শামির লেখক আল্লামা মোহাম্মদ আমিন (রহ.)-এর মৃত্যু ১২৫২ হিজরিতে, এবং বর্তমানে চলছে ১৪২৮ হিজরি। আমাদের সময় থেকে ফতোয়ায়ে শামির লেখক ইবনে আবেদিনের সময়ের ব্যবধান মাত্র একশ ছিয়াত্তর বছর। যেহেতু আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাবিজের পে ‘আহসানুল ফতোয়া’ গ্রন্থ থেকে তথ্যের খণ্ডাংশ নিয়ে পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন, তাই আমাদের উচিৎ ‘আহসানুল ফতোয়া’র পূর্ণাঙ্গ আলোচনাটি দেখা। আমাদের শ্রদ্ধাভানজ আকাবির মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী(রহ.)-এর প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা রেখে ‘আহসানুল ফতোয়া’র সকল খণ্ড পাঠ করলে আশা করি আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিবও এই কথা স্বীকার করবেনÑ‘ আহসানুল ফতোয়া’ প্রকৃত অর্থে ফতোয়ার উপাদান হলেও ফতোয়ার কিতাব নয়, এটা মূলত মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী(রহ.)এর প্রশ্নোত্তর মূলক একটা বক্তব্য কিংবা স্মারকও বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থে মুফতি সাহেবের প্রচুর এমন বক্তব্য রয়েছে যার সাথে আমাদের অন্যান্য আকাবিরদের অত্যন্ত দ্বি-মত দেখা যায়। ইতোমধ্যে আমি দু’একটি আলোচনা করেছি। তা ছাড়া খোদ মুফতি সাহেবেরও স্ববিরোধী অনেক কথা রয়েছে ‘আহসানুল ফতোয়া’র অনেক আলোচনায়। এই স্ববিরোধীতা দেখা যেতো না যদি মুফতি সাহেব নিজে এই গ্রন্থের লেখক হতেন। তাবিজ-কবজ বিষয়ে মুফতি সাহেব কিন্তু দৃঢ়ভাবে কোন মতামত দেননি। অনেকটা সন্দেহের ভেতর দিয়ে হেটে তিনি প-েবিপরে কিছু বক্তব্য এবং হাদিস বর্ণনা করে শেষ পর্যন্ত মন্তব্য করেছনÑ‘আল্লাহ জানেন’ বলে। আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাবিজ জায়েয করতে আহসানুল ফতোয়ার ৮ নম্বার খণ্ডের ২৫৫ নম্বার পৃষ্টার সংপে বর্ণনা দিয়ে যে অপপ্রয়াস চালিয়ে ছিলেন, আশা করি পাঠকের সামনে ইতোমধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবু সম্মানিত পাঠকদেরকে বলবো, আমার কথাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে আপনারাই ‘আহসানুল ফতোয়া’ এবং সেখানে বর্ণিত হাদিসসমূহের অর্থ, ব্যাখ্যা, শানে নুজুল দেখুন। বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাবিজের ফজিলতে আরেকটি দলিল বলেছেন,‘ ইমাম আবু বাকর ইবনে আবী শাইবাহ ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, আমর ইবনে শুআইব তার পিতা ও তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদের কেউ যখন ঘুমন্ত অবস্থায় ঘাবরিয়ে উঠে, সে যেন ‘বিসমিল্লাহি আউযু বিকালিমাতিল্লাহি তাম্মা....’ দুআটি পাঠ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তাঁর উপযুক্ত সন্তানদের তা শিা দিতেন এবং ছোটদের গলায় তা লিখে লটকিয়ে দিতেন। এই হাদিসটি ইমাম আবু দাউদ (রহ.) তার সুনানে আবু দাউদে ও কিতাবু-তিব্বের *** কাইফা রাক্বি’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। উপরোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমানিত হলÑ তাবিজ দেওয়া জায়েয। যদি শিরক হত তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) এর মতো বিখ্যাত বুযুুর্গ সাহাবী তাবীজ লিখে ছোট ছোট শিশুদের গলায় লটকিয়ে দিতেন না। বিধায় কোন হাদিস পেলেই তার ব্যাখ্যা, মর্মার্থ প্রয়োগ স্থল না বুঝে কোন কিছুর ব্যাপারে শিরকের সার্টিফিকেট লাগানো আদৌ ঠিক নয়।’(আল-হেলাল ২৯৯৭Ñ৮, পৃষ্টা ৯৪)। বন্ধু ইবনে তায়্যিবের এই উক্তিÑ‘ বিধায় কোন হাদিস পেলেই তার ব্যাখ্যা, মর্মার্থ প্রয়োগ স্থল না বুঝে কোন কিছুর ব্যাপারে শিরকের সার্টিফিকেট লাগানো আদৌ ঠিক নয়’ তাকেই ফিরিয়ে দিয়ে বলতে চাই, নিশ্চয় আপনি দেখেছেন, এই হাদিসের যে অংশ স্বয়ং রাসুল (স.) থেকে সেখানে বলা হয়েছে ‘ফালিকুল’, আর এই শব্দের অর্থে স্বয়ং আপনিও লিখেছেন ‘ পাঠ করে’। আর আব্দুল্লাহ ইবনে আমর অংশে উপযুক্ত সন্তানদের েেত্র বলা হয়েছে ‘ ইয়ালামুহা’, যার অর্থে আপনি স্বয়ং লিখেছেন ‘ শিা দিতেন’। আর যাদের গলায় লিখে লটকিয়ে দেওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছেÑতারা ছিলো ছোট ছোট শিশু। আশা করি লেখক জানেন, শরিয়তের দৃষ্টিতে বাচ্চারা যে মুকাল্লফ নয়। ইতোমধ্যে আমি মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের বক্তব্যের উত্তরে এবিষয়ে আলোচনা করেছি। এই হাদিস পাঠের পর একটি প্রশ্ন মনে জাগে, হযরত নবি করিম (স.) ‘দুআটি পাঠ করো’ না বলে কি বলতে পারতেন না ‘ দোয়াটি লিখে শরিরের সাথে লটকিয়ে রাখো’, আর হাদিসে উপযুক্ত সন্তান এবং শিশুদেরকে কেনো পৃথক করা হলো? মোটকথা হলো, এই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেই পাঠক দেখবেন তাবিজ-কবজের সকল বৈধতা হারিয়ে যায়। একটা কথা আমাদেরকে স্পষ্ট বুঝতে হবেÑহাদিস এবং হাদিসের পাশাপাশি বর্ণনাকারির বক্তব্য এক জিনিষ নয়। এই দুই জিনিষকে পৃথক করে দেখতে হবে। পাশাপাশি বর্ণনাকারীর মধ্যে সাহাবী এবং তাবেয়ীকে পৃথক করতে হবে। তাবেয়ী এবং তবেÑতাবেয়ীকে পৃথক করে দেখতে হবে। এভাবে হযরত রাসুল (স.) থেকে পৃথিবী যতদুরে যাবে তাকে ততই পৃথক করে দেখে একটি হাদিসের ব্যাখ্যাকারিকে বিবেচনা করতে হবে। যদি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যোগসূত্রে কোন ত্র“টি না থাকে তবে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি কম-বেশি হয় তবে যাদের কথা বেশি মিলবে হযরত সাহাবায়ে কেরাম (র.)দের ব্যাখ্যার সাথে তাদের কথা আমরা গ্রহণ করবো। আর হানাফি মাযহাব অনুযায়ি আমরা অন্যান্য সাহাবী থেকে বেশি গুরুত্ব দেবো ফকিহ সাহাবীদেরকে।অতঃপর বন্ধু ইবনে তায়্যিব লিখেনÑ***ইবনে আবী শাইবাহ মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মুজাহিদ (রহ.) লোকদের জন্য তাবিজ লিখে তাদের গলায় লটকিয়ে দিতেন। এমত তিনি আবূ জাফর, মুহাম্মদ বিন সীরিন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর এবং যাহ্হাক প্রমূখ থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা তাবিজ লেখা, তাবিজ গলায় লটকানো, অথবা হাতে বাঁধাকে বৈধ মনে করতেন। উপরে যেসব তাবিয়ীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে তারা ছিলেন দুনিয়া বিখ্যাত সর্বজন অনুসৃত। এসব তাবিয়ীদের থেকেও কি শিরকের কল্পনা করা যায়? না এসব দুনিয়া বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত হাদীসগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন?’ আমরা বন্ধু ইবনে তায়্যিবের প্রশ্নের উত্তরে বলবোÑনাউযুবিল্লাহ, এই সব বুজুর্গ আকাবিরদের ওপর শিরকের তহমত কিংবা হাদিস না বুঝার কথা বলার মতো সাহস আমাদের কারো নেই। তবে আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব যে ইবনে আবী শাইবাহ (রহ.)Ñএর সূত্রে আরবি ভাষায় মুজাহিদ (রহ.)র তাবিজ লটকানোর ঘটনা বর্ণনা করলেন, তা আমরা সহীহ বা সত্য বলে বিশ্বাস করবো কোন সূত্রে? আমরা জানি যে, আরবি ভাষার বিধান হলো, ‘জুমলাÑএÑখবরিয়া’ সত্য কিংবা মিথ্যা যে কোন একটা হতে পারে। তিনি যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তা আবশ্যই ‘ওহী-এ-মতলু’(কোরআন) কিংবা ‘ ওহীÑএÑগায়ের মাতলু’(হাদিস) কিছুই নয়। অথচ তাবিজের বিরুদ্ধে অসংখ্য ‘ওহীÑএÑগায়ের মতলু’ অর্থাৎ হাদিস রয়েছে এবং এই হাদিসগুলো সহীহ হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে হয় স্বয়ং আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিবেরও দ্বিমত নেই। ইতোমধ্যে বন্ধু আমার যে দলিলগুলো দিয়েছেন তাবিজের প,ে তাতে হযরত রাসুল (স.)এর পরবর্তী মুসলমানদের তৃতীয় প্রজন্মের কোন কোন বুজুর্গের কিয়াসের বর্ণনা থাকলেও হাদিস কিংবা ইজমাÑএÑ সাহাবা অথবা ইজমাÑএÑউম্মত নেই। যে বুজুর্গদের কিয়াসের বর্ণনা আমার বন্ধুমহুদয় দিয়েছেন সেখানেও পাঠক তীè দৃষ্টি দিলে দেখবেন বর্ণনায় বেশ চালাকি কিংবা বর্ণনাকারির অনুধাবনের অমতা রয়েছে। ইতোমধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের ঘটনায় আমরা দেখেছি তিনি উপযুক্তদেরকে পাঠ শিখাতেন আর শিশুদের গলায় লিখে লটকিয়ে দিতেন। আর শরিয়তের ভাষায় শিশুরা হলো গয়ের মুকাল্লাফ, অর্থাৎ তারা শরিয়ী আইনের উর্ধ্বে। মুজাহিদ (রহ.) সম্পর্কে বন্ধু মহুদয় যে বর্ণনা করেছেন সেখানে শুধু বলা হয়েছে, তিনি ‘ ইন্নাহু কানা ইয়াকতুবুন নাস’ অর্থাৎ তিনি লোকদের জন্য তাবিজ লিখে তাদের গলায় লটকিয়ে দিতেন। এখন প্রশ্ন হলোÑএইলোকগুলো বয়সে মুকাল্লাফ ছিলো, না গায়ের মুকাল্লফ ছিলো? তা কিন্তু বর্ণনা করা হয়নি। তাবেয়ী বুজুর্গদের কিয়াসকে তাবিজের দলিল বানানোর অপপ্রয়াস যারা করেন, তাদের চালাকি কিংবা অনুধাবনের অমতা এখানেই। যেখানে মানুষ এক সময় নিজেদের হীনস্বর্থে কিংবা অনারব বর্ণনাকারিদের অনুধাবনের অমতায় হাদিস-এ-রাসুল (স.) জালকরণের কারসাজি শুরু করে দিতে পারলো, সেখানে এই বুজুর্গদের নামে যে তাবিজ ব্যবসায়ী স¤প্রদায় কারসাজি করছেন না, এটা আমরা বিশ্বাস করবো কী ভাবে যেখানে তাবিজের বিরুদ্ধে অসংখ্য সহীহ হাদিস রয়েছে? তাবিজের বিরুদ্ধে আমি হযরত রাসুল (স.)এর যে হাদিসগুলো ইতোপূর্বে আলোচনায় বর্ণনা করেছি, সেগুলো সহীহ হাদিস কি না? বিজ্ঞপাঠকদের সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। কে হাদিস বুঝেননি আর কে বুঝেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরও আমরা পেয়ে যাবো যার যার গবেষণালব্ধ আলোচনা পাঠ করলে। যেখানে সহীহ এবং জঈফ হাদিসের সংজ্ঞা, ইতিহাস এবং বর্ণনা পড়লে দেখা যায় অনেক প্রচলিত এবং প্রসিদ্ধ হাদিসও বাতিল হয়ে গেছে অকাট্য এবং নির্ভরশীল দলিলের অভাবে, সেখানে আমরা ঐসব উক্তিসমূহের প্রতি আস্থা রাখবো কিসের ভিত্তিতে, যদি তা কোরআন, হাদিস কিংবা ইজমায় পাওয়া না যায়? এই তিনের যুগসূত্রে যদি কিয়াস না আসে তবে কী তা গ্রহণযোগ্য? অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ফিক্হ কোরআন-হাদিস থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বরং কোরআন-হাদিসের বিস্তারিত প্রমাণাদি থেকে উদ্ভাবিত আমলী শরিয়তের বিধি-বিধানের নাম ফিক্হ। কোরআন-হাদিস হলো ‘ফিকহের আদিল্লায়ে তাফসীলিয়া’। প্রসঙ্গক্রমে আমি ইমাম আবু হানিফা (র.) এর এই বক্তব্য আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিবকে শোনাতে চাই-‘ যা কিছু রাসুল (স.) থেকে তা আমার মাথার মুকুট ও চোখের জ্যাতি হিসেবে বিনাবাক্যে গৃহিত, এতে আমার মতবিরোধের কোন অবকাশ নেই। আল্লাহর রাসুল (স.) এর প্রতি আমার মা-বাবা উৎসর্গিত হোক। আর যা কিছু সাহাবি (রা.) থেকে বর্ণিত, তা থেকে আমরা আমাদের সাধ্যমতো যার বক্তব্য ইচ্ছা গ্রহণ করি। আর যা তাদের ছাড়া অন্যদের থেকে বর্ণিত তখন আমাদের বক্তব্য হলোÑতারাও পুরুষ এবং আমরাও পুরুষ। অর্থাৎ এই সময় আমরা তাঁদের ন্যায় ইজতিয়াদ করি।’(আলÑমীযান, আল্লামা শা’রানী, পৃষ্টা ৫২)। বন্ধু ইবনে তায়্যিব, দয়া করে আমাদের আকাবির বুজুর্গ তাবেয়ীদের ওপর তহমত দিয়ে একটা শিরক কর্মকে বৈধ করতে যাবেন না। আর যদি আপনি তাঁদেরকে হযরত রাসুল (স.)এর হাদিসের মোকাবেলায় দাঁড় করিয়ে দেন, তবে আমরা বাধ্য হয়ে ইমাম আবু হানিফা (র.)এর মতো বলবোÑতারাও পুরুষ এবং আমরাও পুরুষ। তাদের কাছ থেকেও ভুল হতে পারে। আমরা ভুলে না গিয়ে সত্যে থাকবো। তাবিজের পে আপনার দলিলের তালিকায় ‘ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া’ গ্রন্থের ১৯ নম্বার খণ্ডের ৬৪ নম্বার পৃষ্টার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেনÑ‘ সর্বজন মান্য বিশেষত: সালাফিরা যার পদে পদে অনুসরণ করে সেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া(রাহ.)-এর দৃষ্টিতেও তাবিজ-কবজ বৈধ।’ আপনার বক্তব্যানুসারে তিনি লিখেছেনÑ‘বিপদগ্রস্থ বা অসুস্থ লোকদের জন্য কালি দ্বারা আল্লাহর কিতাব লিখে তাবিজ দেয়া এবং ধুয়ে পান করানো জায়িজ।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার এই বক্তব্য বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রসঙ্গিক আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনার দাবি রাখে। আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাঁর এই লেখায় ইতোপূর্বে বলেছেনÑ‘আকিদার মানদণ্ডে তাবিজাত’ গ্রন্থের লেখক আল্লামা আলী বিন নকী আলÑউলয়ানী একজন বিখ্যাত সালাফি আলেম। এবং সালাফিরা হলো বর্তমান যুগের সবচে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ।’ অথচ এখানে এসে তিনি নিজেই বলছেন ‘সর্বজন মান্য বিশেষত: সালাফিরা যার পদে পদে অনুসরণ করে সেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)।’ এখন আমাদের প্রশ্ন হলো যিনি সর্বজন মান্য ইমাম, তিনিকে যারা পদে পদে অনুসরণ করে, তারা কী ভাবে যুগের সবচেয়ে ভয়াবহ বাতিল মতবাদ হয়ে গেলো? এখানে আমার বন্ধুর উত্তরতো আমার জানা নেই, তবে তিনির বক্তব্যের ধরণ থেকে মনে হচ্ছে উত্তরটা এমন-যখন যাদের মতের সাথে তিনির মতের মিল হবে, তখন তিনি তাকে সর্বজন মান্য বলে স্বীকৃতি দানে কার্পণ্য করবেন না। আর যখন কারো মতের সাথে তাঁর মতের পার্থক্য হবে, হোক মতপার্থক্যকারির মতামত হাদিসে রাসুল(স.) নীতি অনুসারে, তবু সে হয়তো বাতিল মতবাদ, গোমরাহ কিংবা সে আটকা পড়ে গেছে ওদের চোরাবালিতে। আবার উত্তর তাও হতে পারেÑসর্বজন মান্য ইমামকে অনুসরণ করেও কেউ কেউ ভ্রান্তপথে চলে বাতিল মতবাদী হতে পারেন। তবে তিনি যখন বলেন ‘ সালাফিরা যার পদে পদে অনুসরণ করে’ তখন আবার প্রশ্ন জাগেÑএকজন সর্বজন মান্য ইমামকে পদে পদে অনুসরণ করে তারা বাতিল মতবাদ হলো কোন পদে? তা হলে কি বন্ধু ইবনে তায়্যিবের বক্তব্যই প্রমাণ দিলো না যে, সালাফিরা ভয়াবহ বাতিল মতবাদ নয়? একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে যে, মতপার্থক্য আর মতভেদের মধ্যে ব্যবধান আছে, ব্যবধান আছে খেলাফ আর ইখতেলাফের মধ্যে। সালাফিদের সাথে আমাদের প্রচুর মতের পার্থক্য আছে, আছে ইখতেলাফ। কিন্তু এই মতের পার্থক্যকে পৃথক কোন ‘মতবাদ’ কিংবা ‘খেলাফ’ বলা যাবে না। সালাফিদের মধ্যে যেমন কিছু উগ্র তর্কবাগিশ আছেন, যারা হযরত ইমাম আজম আবু হানিফা (র.) সম্পর্কে না জেনে গালাগালি করেন, তেমনি আমাদের হানাফিদের মধ্যেও এমন অনেক আছেন যারা আহলে হাদিস বা সালাফিদেরকে না বুঝে মনে করেন ভয়াবহ বাতিল মতবাদ। কিন্তু উভয়গ্র“পের মুহাক্কিক ওলামাগণের সরাসরি বক্তব্য এবং লেখা থেকে আমি ল্য করেছি যে, তারা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অতীতে যেমন ছিলেন, তেমনি আজও আছেন। ইতোমধ্যে আমি আহসানুল ফতোয়ার লেখক মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী (র.)Ñএর আহলে হাদিস সম্পর্কিত বক্তব্য উল্লেখ করেছি। আর আহলে হাদিস বা সালাফিদের তাত্ত্বিক বলে খ্যাত এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.)এর বিশেষ শিষ্য হযরত ইমাম হাফেজ ইবনে কায়্যেম (র.) তাঁর কিতাবে ইমাম আবু হানিফা (র.) সম্পর্কে বলেন-‘ ইমাম আজম আবু হানিফা (র.) এর শিষ্যগণের বক্তব্য থেকে আমি জানতে পারি, ইমাম সাহেব যাঈফ বা দুর্বল হাদিসকেও ইজতেহাদ ও কিয়াস থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।’(আ’লামুল মু’কিয়ীন)। যাই হোক, আমরা ফিরে আসি আমাদের মূল কথায়। আমার বন্ধু বলেছেন, ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়ার ১৯ নম্বার খণ্ডের ৬৪ নম্বার পৃষ্টায় বলা হয়েছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নাকি তাবিজ লিখে সন্তানসম্ভবা নারীদের বাহুতে বেঁধে দিতেন। (নাউযুবিল্লাহ)। আমার বন্ধু যে ‘ফতোয়ায়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া’ গ্রন্থ না পড়েই তথ্য উল্লেখ করেছেন, তা তাঁর নিজের বক্তব্য এবং কর্ম থেকেই প্রমাণিত হয়। তিনি লিখেছেন-ইমাম ইবনে তাইমিয়া তা বলেছেন ১৯ নম্বার খণ্ডের ৬৪ নম্বার পৃষ্টায়। অথচ ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়ার ১৯ নম্বার খণ্ডে তাবিজ কিংবা চিকিৎসা বিষয়ক কোন আলোচনাই নেই। তবে ‘শুধু কোরআনের আয়াত কিংবা দোয়ায়ে মাসুরা লিখে তাবিজ লটকানো বৈধ’ এতটুকু উক্তি ইমাম ইবনে তাইমিয়া করেছেন তাঁর ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া’ গ্রন্থের ২৪ নম্বার খণ্ডে। তবে এখানে ইবনে আব্বাস সম্পর্কিত উক্তিটি নেই। ‘তাবিজ জায়েজ’ এই কথা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নিজস্ব কিয়াস, যা হাদিস নয়। হাদিস সামনে রেখে কেউ চাইলে এর সাথে দ্বি-মতও করতে পারেন। যেমন তাঁর এই মতের সাথে দ্বি-মত প্রকাশ করেছেন স্বয়ং তাঁর স্নেহভাজন ছাত্র ইমাদুদ্দিন ইবনে কসির (র.) তাফসিরে ইবনে কাসিরে সুরা ইউসুফের ব্যাখ্যায়।( বিস্তারিত দেখুন ‘ কোরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?’ গ্রন্থে)। যে আলÑহিলাল ম্যাগাজিনে বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাবিজের পরে লিখেছেন, এই ম্যাগাজিনের ৭৩ নম্বর পৃষ্টায় ‘সালাফি ফেতনার সর্বগ্রাসী রূপ ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক একটি লেখায় ইমাম ইবনে তাইমিয়ার তাবিজের পরে ফতোয়াকে বলেছেনÑ‘ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়ার ১১ নম্বর খণ্ডের ৬৩ নম্বর পৃষ্টায়।’ অথচ এই খণ্ডেও তাবিজের কোন আলোচনা নেই। আমার আলোচ্য বিষয় ঐ লেখা নয়, তাই সেদিকে যাচ্ছি না। আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব ‘লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত দলীলসমূহের জবাব’ শিরোনামে লিখেছেন-‘লেখক বিখ্যাত সালাফী আলিম আল্লামা উলয়ানীর অনুকরণে******* ইত্যাদি আয়াত দ্বারা তাবিজাতকে শিরক সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। আসলে এসব আয়াত দ্বারা তাবিজ নাজায়িয হওয়ার পে দলীল দেওয়া সম্পূর্ণ হাস্যকর ও শিশুসুলভ কাণ্ড। যারা তাবিজ কবজকে বৈধ বলছেন তারা তো ঢালাও ভাবে তাবিজ বৈধ বলেন নি। বরং তারাও তো বলেছেন তাবিজের উপর ভরসা করা চলবেনা।’ প্রথমত আমার বন্ধু যখন তাঁর পে সালাফিদের ইমাম বলে খ্যাত আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)এর দলিল পেয়ে গেলেন, তখন তাকে স্বীকার করলেন ‘সর্বজন মান্য’ বলে। আর যখন বিরুদ্ধে পেলেন ‘ আল্লামা উলয়ানী’কে তখন সালাফিদেরকে বাতিল মতবাদী বলতে শুরু করেন। বন্ধু আমার, আমি তাবিজ বিষয়ক কোরআনের আয়াতের অর্থ এবং ব্যাখ্যা বেশিরভাগে নিয়েছি হয়তো ইমাম ইবনে তাইমিয়ার প্রিয় ছাত্র ইমাম ইবনে কাসিরের বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘ তাফসিরে ইবনে কাসির’ কিংবা আমাদের হানাফি মাযহাবের আকাবির মুফতি মুহাম্মদ শফি (র.)এর বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘মাআরিফুল কোরআন’ থেকে, যা বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, তাবিজকে শিরক সাব্যস্ত করার কোন চেষ্টা আমি করিনি। আমি শুধু তাবিজ শিরক হওয়া সম্পর্কিত হাদিসগুলোর সমন্বয়ের চেষ্টা করেছি। তাবিজ শিরক বা জায়েয হওয়ার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ নেই। আমার স্বার্থ একটাই-মানুষকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জঘণ্যমত ফেতনা ‘তাবিজ’-এর শরয়ি বিধান জানিয়ে দেওয়া। বিষয়টি আপনার কাছে সম্পূর্ণ হাস্যকর ও শিশুসুলভ কাণ্ড মনে হলেও কোরআন, হাদিস, ফেকাহ এবং ইজমার তথ্য যারা রাখেন এবং পূর্ণাঙ্গ ঈমান রাখেন এগুলোর ওপর, তাদের কাছে তাবিজাতের ফেতনা মোটেও হাস্যকর নয়। আর আপনি নিজে যখন বলছেন, আপনারা সর্বপ্রকারের তাবিজকে ঢালাওভাবে বৈধ মনে করেন না এবং এর উপর ভরসা করা চলবে না, তখন আপনার শুভবুদ্ধির কিছুটা উদয় দেখে আমি আশাবাদি হই, আপনি আরেকটু চেষ্টা করলে মঞ্জিলে পৌঁছে যেতে পারবেন। আমি আপনার লেখায় স্পষ্ট দেখেছি, মঞ্জিলে পৌঁছার একটা কাকুতি আপনার ভেতরে আছে, যা মূর্খতাজনিত কারণে অনেকেরই থাকে না। মূলত যাদের ভেতরে এই কাকুতিটুকু থাকে তারাই হেদায়তপ্রাপ্ত হয়, চেষ্টার এক পর্যায়ে তারা সত্য-মিথ্যার ব্যবধান বুঝতে পারেন। আর তবু যদি আপনি হাদিস শিক্ষার পরও হাদিস থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন কোন তাবেয়ী কিংবা বুজুর্গদের ব্যক্তিগত রায় বা কিয়াসকে, তবে এ সম্পর্কিত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)এর মাযহাবি রায়টি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-‘*** যে ব্যক্তি বলে, আমরা কিয়াসকে নস (কোরআন-হাদিস) এর ওপর প্রাধান্য দিয়েছি, আল্লাহর কসম! সে আমাদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ এবং মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। (আমরা বলবো) নস থাকা অবস্থায়ও কি কিয়াসের গুরুত্ব আছে।’ (আল-মিযান, আল্লামা শা’রানী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্টা ৫১। ইমাম আবু হানিফার জীবন ও ফিক্হ, পৃষ্টা-২৩৬)। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন-নস না পেলে কিয়াস হবে, কিন্তু নস থাকলে কোনো কিয়াস নেই। আবু হানিফা (রহ.) আরো বলেন-‘*** আমরা একান্ত প্রয়োজনে নিরুপায় হয়েই কেবল কিয়াস করি।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্টা ২৩৭)। ইমাম আবু হানিফা (র.) নসকে চার ভাবে দেখতেন। যেমন, ১) ইবারাতুন নস, অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের প্রত্য মৌল বক্তব্য। ২) ইশারাতুন নস, অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের ইঙ্গিতমূলক বক্তব্য। ৩) দালালাতুন নস, অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের সমর্থনমূলক বক্তব্য ৪) ইকতিযাউন নস, অর্থৎ কোরআন-হাদিসের সূমর্মমূলক বক্তব্য। ইমাম আবু হানিফা (র.) যখন ‘ইবারাতুন নস অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের প্রত্য মৌল বক্তব্য’ পেয়ে যেতেন তখন মাসআলা বর্ণনায় অন্য কোনদিকে দৃষ্টিপাত করতে না। যদি ইবারাতুন নস না পাওয়া যেতো তখন ইমাম আবু হানিফা (র.) ‘ইশারাতুন নস অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের ইঙ্গিতমূলক বক্তব্য’কে গুরুত্ব দিতেন। যদি এখানেও কিছু না পাইতেন তখন ‘দালালাতুন নস, অর্থাৎ কোরআন-হাদিসের সমর্থনমূলক বক্তব্য’কে গুরুত্ব দিতেন। আর সর্বশেষে তিনি ‘ইকতিযাউন নস, অর্থৎ কোরআন-হাদিসের সূমর্মমূলক বক্তব্য’কে সুèাতিসূè নিগূঢ় তত্ত্বে পৌঁছে গুরুত্ব দিতেন। ইমাম আবু হানিফা (র.) মনে করতেন-‘ শরিয়তের মাসাইল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে (নস) কোরআন-হাদিস হলো মূল ( আসল)। যদি কোরআন-হাদিসে কোন বিষয় স্পষ্ট পাওয়া না যায় তবে কিয়াস জায়েয। যদি সহীহ সূত্রে পূর্ণাঙ্গ সনদসহ কোন হাদিস পাওয়া যায় তবে এর উপর আমল করতে হবে। খবরে মুফরাদের তুলনায় ইজমার গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিসের যাহেরি অর্থ (ইবারাতুন নস) প্রযোজ্য হবে। অবশ্য একই হাদিসের মধ্যে যদি একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে তবে জাহেরী অর্থের সাথে যেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেটি ধর্তব্য ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি কোন বিষয়ে একাধিক হাদিস বিদ্যমান থাকে তা হলে সে েেত্র যে হাদিসটি সনদের দিকে বিশুদ্ধ সেটি অগ্রাধিকার পাবে। এক আসলের উপর অন্য আসলকে অর্থাৎ এক হাদিসের উপর অন্য হাদিসকে কিয়াস করা যাবে না। আর কোন হাদিসের েেত্র একথাও বলা যাবে না যে, কেন এবং কি ভাবে এটি মূলনীতি হলো। যখন কোন হাদিসের উপর কিয়াস করার বিষয়টি সহীহ বলে প্রমাণিত হবে তখন দলিল হিসেবে গ্রহণ করাও সহীহ হবে। ( আলÑফিক্হ ওয়াল ফুকাহা, পৃষ্টা-৯২)। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামের যেকোন বিধান মানার েেত্র হযরত সাহাবায়ে কেরামের রায় কে অনুসরণ করা ওয়াজিব মনে করতেন। কোন বিষয়ে সাহাবীদের রায় থাকলে তিনি অন্য কারো বক্তব্য শোনতেন না। তিনি তাবেয়ীদের তাকলিদ করতেন না।’ ( ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, পৃষ্টা ১০০)। হাদিসের বর্ণনাকারি হযরত সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যেও ইমাম আবু হানিফা (র.) বেশি গুরুত্ব দিতেন ফকিহ সাহাবীদেরকে। একবার মক্কা শরিফের ‘দারুল খায্যাতিন’Ñএ হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) কে হযরত ইমাম আওয়াই (র.) জিজ্ঞাস করলেনÑআপনি রুকুতে যেতে এবং রুকু থেকে উঠে রফেঈদাইন করেন না কেনো? ইমাম আবু হানিফা (র.) বললেনÑ সহীহ হাদিস দিয়ে প্রমানিত নয় বলে। ইমাম আওযাঈ (র.) আশ্চর্য হয়ে বললেনÑ‘ অথচ আমাকে যুহরী (র.) বলেছেন, তিনি সালিম থেকে, সালিম তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি রাসুল (স.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হাত উঠাইতেন।’ তখন ইমাম আবু হানিফা বলেন-‘ আমাকে হাম্মাদ বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহিম (র.) থেকে, ইবরাহিম আলকামা ও আসওয়াদ থেকে এবং তাঁরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) নামাজের শুরুতে হাত উঠাইতেন। তা ছাড়া নামাজের মধ্যখানে হাত উঠাইতেন না। তখন ইমাম আওযাই (র.) বলেন-‘ আমি আপনাকে যহরী (র.) এর সূত্রে সালিম (র.) থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা.) থেকে যে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তা শুনাচ্ছি আর আপনি আমাকে হাম্মাদ (র.)এর সূত্রে ইবরাহিম (র.)এর বর্ণনা শুনাচ্ছেন? উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (র.) বলেন-‘ হাম্মাদ (র.) যুহরী (র.)-এর তুলনায় বড় ফকিহ ছিলেন। ইবরাহিম (র.) সালিম (র.) এর তুলনায় বড় ফকিহ ছিলেন। আর আলকামা (র.) ইবনে উমর (রা.) থেকে কোন অংশেই কম নন যদিও ইবনে উমর (রা.) সাহাবী ছিলেন। আর আসওয়াদ (র.) তো অনেক গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ইবরাহিম (র.) সালিম(র.)এর তুলনায় বড় ফকিহ ছিলেন। যদি সুহবত তথা সাহচর্যের ফজিলত না থাকতো তবে আমি বলতাম, আকলামা (র.) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকেও বড় আলেম ও ফকিহ ছিলেন। আর আব্দুল্লাহ তো হলেন আব্দুল্লাহই।’ ( ইমাম আবু হানিফার জীবন ও ফিকহ, শায়েখ আবু যুহরা, পৃষ্টাÑ২৪৪-২৪৫, দারুল ফিকর আল-আরাবি)। শায়েখ আবু যুহরার মতে এখানে ইমাম আবু হানিফা(র.) আব্দুল্লাহ দিয়ে বুঝিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কে। ইমাম আবু হানিফা (র.) উপরোক্ত রাবীগনের মধ্যে কাউকে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সমক মনে করতে না। কারণ, তাঁর কাছে রাবীর েেত্র ফকিহ’র গুরুত্ব ছিলো বেশি। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) ছিলেন সাহাবাদের মধ্যে বড় ফকিহ। তাঁকে ফকিহুল উম্মত বলা হয়ে থাকে। এই ঘটনা থেকে আমরা একদিকে যেমন হানাফি মাযহাবে হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হলাম, তেমনি হাদিসের রাবীদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (র.)এর কাছে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের গুরুত্ব যে বেশি, তা বুঝলাম। এখন আমরা যারা নিজেদেরকে হানাফি মাযহাবের লোক বলে দাবি করি, তাদের দেখা উচিৎ সেই আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তাবিজ সম্পর্কে কি বলছেনÑ‘সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী হযরত যয়নাব (রা.) বলেন, ‘আমার স্বামী হযরত আব্দুল্লাহ বাহির থেকে বাড়িতে প্রবেশ করতে গলা খাঁকড়াতেন এবং থু থু ফেলতেন। কারণ যাতে বাড়ির লোকেরা তাঁর আগমনের সংবাদ পায় এবং তাদেরকে তিনি এমন অবস্থায় না দেখেন যা তাঁর অপছন্দনীয়।’ এটা তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস ছিলো। অভ্যাস অনুযায়ী একদিন তিনি এমনভাবে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। এই সময় আমার কাছে এক বুড়ি ছিলো, সে আমার রোগের জন্য ঝাড়-ফুঁক দিতে এসেছিলো। আব্দুল্লাহ্ (রা.)-এর গলার আওয়াজ শোনে আমি বুড়িকে চৌকির নিচে লুকিয়ে দেই। তিনি ঘরে এসে আমার পাশে চৌকির উপর বসেন এবং আমার গলায় তাগা দেখে জিজ্ঞেস করেন এটা কী? উত্তরে বললাম এটা আমি ঝাড়-ফুঁক করিয়ে গলায় বেঁধেছি। সাথে সাথে তিনি তা ছিড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন-‘আব্দুল্লাহ্র ঘর শিরকের অমুখাপে,ি স্বয়ং আমি রাসুল (সা.)কে বলতে শোনেছি যে-**অর্থ: ঝাড়-ফুঁক, তাবিজাবলী এবং ডোরা-সুতা বাঁধা র্শিক। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, হাকেম, ইবনে মাজা)।ফকিহুল উম্মাত বলে ইমাম আবু হানিফা যে সাহাবীকে ঘোষণা করেছেন, সেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) যদি হযরত রাসুল (স.)এর বক্তব্যের সূত্রে তাবিজ-কবজকে শিরক ফতোয়া দেন, অতঃপর যদি পরবর্তিতে কেউ তাবিজÑকবজ বৈধ করার অপচেষ্টা করেন, আর তিনি নিজকে হানাফি মাযহাবের লোক বলে দাবি করেন, তবে বিষয়টা খুবই হাস্যকর হয়ে যায় না? এত গুরুত্বপূর্ণ সাহাবী (রা.)Ñএর বক্তব্য দেখার পরও যদি আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব তাবিজকে হালাল করতে হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শামী (রহ.)র ‘রাদ্দুল মুহতার’ গ্রন্থে উল্লেখিত ****‘রাকিয়া’ শব্দের অর্থ উঠিয়েদেনÑ ‘তাবিজ’, তবে আমাদের আর কি বলার আছে? অথচ আমরা দেখতে পাই, হযরত নবি করিম (স.) থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম (র.) হয়ে আমাদের আকাবির মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভী(র.) পর্যন্ত সকলেই ‘রাকিয়া’ বলেছেন ঝাড়-ফুঁক আর ‘তামিমা’ বলেছেন তাবিজকে। স্বয়ং বন্ধু ইবনে তায়্যিব নিজেই যখন বলেন-‘যদি ‘রাকিয়া’ শব্দের অর্থ তাবিজ মানা যায় তা হলে তাবিজ বৈধ হওয়ার পে মারফু হাদিসের অভাব নেই। কারণ, অসংখ্য হাদীসে আল্লাহর রাসুল(স.) বলেছেন রাকিয়া জায়েয।’ ‘রাকিয়া’ জায়েযের ব্যাপারে আমার কোন ব্যক্তব্য নেই, যেহেতু হাদিসে শিরকমুক্ত রাকিয়া বা ঝাড়-ফুঁককে জায়েয বলা হয়েছে, আমাদের প্রশ্ন হলো ‘তামিমা বা তাবিজ’ নিয়ে। আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব হয়তো ভালো করেই জানেন যে, শরিয়ত কিংবা আইনের কোন ফয়সালায় যেতে হলে ‘যদি’ শব্দের ওপর নির্ভর করা করা যায় না। ‘যদি’ শব্দটা হলো সন্দেহজনক। আমার বন্ধু যেভাবে ‘যদি’ আর বিভিন্ন হাদিস এবং তাবিয়ীদের বক্তব্যের খণ্ডাংশ বর্ণনা করে তাবিজকে বৈধ করার ইজতিহাদের পথে গিয়েছেন, তা খুবই লজ্জাস্কর এবং ভাবনার ব্যাপার। যেখানে তাবিজের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অসংখ্য সহীহ হাদিস আছে সেখানে কোন কোন তাবেয়ীদের অস্পষ্ট আমলকে ভিত্তি করে তাবিজকে বৈধ করার চেষ্টা হানাফি মাযহাবের নীতি বিরুদ্ধ, দীনের তাহরীফ ও বিকৃতি, ইসলামী শরিয়তের মূল দলিলের বিরুদ্ধাচারণ এবং প্রকৃত ইসলামের মূলোৎপাটনের সমতুল্য। এখানে আপনাকে একটি অনুরোধ করবো, আপনি যে নীতিগুলোর ভিত্তিতে তাবিজাতের বৈধতা স্বীকার করছেন, সে নীতিগুলো সামনে নিয়ে ঈমানের আলোকে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুনÑবর্তমানে পাক, ভারত, বাংলায় যে তাবিজÑকবজের ফেতনা চলছে তা কি এই নীতির ভেতরে আসে? এগুলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব কি শিরকে পরিপূর্ণ নয়? অনেক আলেম কি এসবের সাথে জড়িত নয়? যদি আপনার উত্তর হয়Ñহ্যাঁ, তবে এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলছেন না কেনো? পৃথক করছেন না কেনো আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির হালালÑহারাম তাবিজ-কবজকে? আর যদি আপনি বলেনÑনা, তবে বলবো পৃথিবীর কিংবা আপনার আশপাশের কোন খবরই আপনি রাখেন না। অবশ্য তাবিজকে আপনি জায়েয মনে করলেও তাবিজ ব্যবসাকে ঘৃণিত কাজ স্বীকার করে অনেকটা সত্যের কাছাকাছি আসায় আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আমিতো জানি, আপনার আশপাশে এসবের সাথে অনেকই জড়িত আছেন। তবে নাম বলবো না দু’টি কারণেÑ১) আমরা অপরাধকে ঘৃণা করি, অপরাধিকে নয়। কারো অপমান করা আমার উদ্দেশ্য নয়, মূল বিষয়টি উপস্থাপনই আমার দায়িত্ব, ২) আমি নাম লিখলে অনেক বড় বড় ব্যক্তিরা এসে যেতে পরেন তালিকায়। এটাকে কেউ কেউ ইস্যু করে নিতে পারেন যে, আমি আলেমদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। নাস্তিক কিংবা পথভ্রষ্ট বলে ফতোয়াও এসে যেতে পারে আপনাদের প থেকে। যেমন আপনার লেখায়ই আপনি শেষ দিকে আমার ওপর মিথ্যা তহমত দিয়েছেন যে, আমি বাংগালি আলেমদের বিষোদগার করেছি, আমি উলামায়ে কেরামের গায়ে শিরকের কালিমা লেপন করেছি, আমি সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমাদের আকাবিরদেরকে হেয়Ñপ্রতিপন্ন করেছি। আরেক জায়গায়তো আকারেÑইঙ্গিতে আপনি হযরত সাহাবায়ে করাম (রা.) এবং তাবিয়ীদের ওপর শিরকের তহমত লাগিয়ে দিয়েছেন, অথচ আপনার এসব অভিযোগ এবং তহমত মোটেও সত্য নয়। প্রথমত; আমাদের আকাবিরদের সম্মান রার্থে আজীবন আমার কলম সংগ্রামের খবর হয়তো আপনিও কিছুটা জানেন। আপনি কেমনে বললেন, আমি আকাবিরদেরকে হেয়Ñপ্রতিপন্ন করেছি? আমিতো শুধু হাদিসÑরাসুলের কথা বলেছি। আর যারা এগুলোকে অপব্যাখ্যা করে নিজেদের স্বার্থে তাবিজ ব্যবসাকে হালাল করতে চেষ্টা করছেন, তাদের সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছি। আর যে জিনিষের বিরুদ্ধে হাদিসে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে সেই জিনিষ কী ভাবে সাহাবায়ে কেরামরা করতে পারেন বলে আপনি বিশ্বাস করেন? না, কখনও তারা শিরক কেনো, তাওয়াক্কুল বিরোধী কাজও করতে পারেন না। আপনি তাবিজের পে যে দু’একজন তাবিয়ীর আমল বর্ণনা করেছেন, আবার পাঠ করে দেখুনÑএগুলো মোটেও তাবিজের পরে দলিল নয়, বরং বিরুদ্ধের দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। আপনি কেনো যে সবকিছুকে এক করে গুলপট্টি মারতে গেলেন, তা বুঝে আসে না। আর আপনি যখন বলেনÑ‘তাবিজের নিজস্ব কোন প্রভাব নেই। রোগ থেকে মুক্তিদানকারী একমাত্র আল্লাহ। তাবিজ ওসীলা মাত্র। তাবিজকে শুধুমাত্র ওসীলা হিসেবে গ্রহণ করা যদি শিরক হয় তাহলে বলতে হবে বৈধ পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণসহ সবধরণের ওসীলা শিরক। তা ছাড়া শুধুমাত্র তাবিজ কেনো, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে কোনো কিছুর উপর ভরসা করা শিরক। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাবিজ গ্রহণ করে তা হলে তা শিরক হতে যাবে কেনো? এসব আয়াতের ভিত্তিতে ঢালাওভাবে সবধরনের তাবিজকে শিরক বলা কি স্থূল জ্ঞানের পরিচয় নয়?’ বন্ধু ইবনে তায়্যিব, তাবিজের প্রভাব আছে কি না, তাবিজ-কবজ মানুষ কেনো ব্যবহার করে? ইত্যাদি আমার বিষয় নয়। আমার বিষয়টা হলো-ইসলামে তাবিজের অবস্থান কি? যদি হালাল হয় তবে আমার কোন আপত্তি নেই। আর যদি হয় হারাম, তবে এই হারামের গায়ে ইসলামের পোশাক ঝুলে গেলো কী ভাবে? আমরা যদি নিজেদেরকে মুসলমান মনে করি তবে কোরআন, হাদিস, ইজমা মেনে আমাদেরকে কিয়াসের পথ অবলম্ভন করতে হবে। শুধু কিয়াস এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদেরকে বুঝতে হবে শরিয়ত কি? ফিকাহ কি? ইবাদত কাকে বলে? আমার বিশ্বাস বন্ধু ইবনে তায়্যিব এসব জানেন। ফিকাহ শাস্ত্রের ভাষায় আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে যদি শরিয়ত বলে তবে অবশ্যই আমাদেরকে শরিয়তের বিধানগুলো দেখতে হবে প্রথমে কোরআনের মধ্যে, পরে হাদিসে। এই দুটিতে যদি স্পষ্ট কিছু পাওয়া যায় তবে অন্যদিকে চোখ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আর যদি স্পষ্ট কিছু পাওয়া না যায় তবে কোরআনÑহাদিসের অস্পষ্ট দিক-নির্দেশনার আলোকে ইজমায়ে সাহাবা (সাহাবাদের ঐক্য) এবং ইজমায়ে উলামা (উলামাদের ঐক্য) দেখতে হবে । যদি ইজমায় দলিল তৈরি না হয়ে থাকে তবে বিভিন্ন দলিলের ভিত্তিতে কিয়াস কার্যকর হবে। স্মরণ রাখতে হবেÑকোরআন, হাদিস এবং ইজমায়ে সাহাবা এই হলো শরিয়তের প্রধান তিন দলিল। কিয়াস মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র কোন দলিল নয়, এই তিন দলিলের ভিত্তিতে পরিচালিত বিষয় মাত্র। কিয়াসের আভিধানিক অর্থ হলোÑঅনুমান করা, সমন্বিত করা। আর ইসলামি শরিয়তের ভাষায় কিয়াস হলোÑ*****‘ মূল বিষয়ের সাথে হুকুম ও ইল্লতের মধ্যে শাখা বিষয়কে তুলনা করা।’ (নুরুল আনওয়ার, বাবুল কিয়াস, পৃষ্টা ২২৮)। আমার বন্ধুর উল্লেখিত হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা শামী(র.) লিখেছেন, কিয়াসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেনÑ‘ নির্ভরযোগ্য বস্তু গ্রহণ করা, দোষযুক্ত বস্তু পরিহার করা এবং মানুষের কার্যক্রমকে গভীর ভাবে পর্যবেন করা। (শামী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্টা ৩৫)। এই নীতি সামনে রেখে আমাদের বুঝতে হবে, কিয়াস জিনিসটা মূলত নতুন বিষয়-নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য। আর তাবিজ নতুন কিছু নয়, একটা পুরাতন বিষয়, যার সমাধান নিয়ে হাদিসে রাসুল(স.)এ স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তাই এটা নিয়ে ইজমাÑকিয়াস পর্যন্ত আসারও প্রয়োজন নেই। ইসলামি শরিয়তের আকিদাÑবিশ্বাস, চরিত্র এবং বাস্তব কাজ-কর্ম সংক্রান্ত নিয়মÑনীতি নিয়ে এই যে প্রধান তিনটি দিক, তা সামনে রেখে মৌলিক দলিল কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে বিধিÑবিধানের জ্ঞানকে ‘ফিকাহ’ বলা হয়। আর ইসলামী আইন বিজ্ঞানীদের মতেÑফকিহ তাদেরকে বলা হয় যারা বাস্তবতা বুঝে শরিয়তের হুকুম-আহকামের জ্ঞান রাখেন। হযরত নবি করিম (স.)এর যুগে ফিকাহ বা ফকিহদের কোন প্রয়োজন ছিলো না। হযরতের সিদ্ধান্তটাই ছিলো চূড়ান্ত রায়। তাঁর পরও যখন হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল(রা.) কে ইয়ামনের শাসনকর্তা নিয়োগ দিয়ে প্রেরণকালে হযরত রাসুল (স.) জিজ্ঞাস করলেন-বিমা তাকজি ইয়া মুয়াজ অর্থাৎ হে মুয়াজ তুমি কিসের ভিত্তিতে বিবাদ ফয়সালা করবে? তখন হযরত মুয়াজ (রা.) বলেনÑবি’কিতাবিল্লাহ,অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব কোরআন দিয়ে। তারপর রাসুল (স.) জিজ্ঞাস করলেনÑফাইল্লাম তাজিদ, অর্থাৎ যদি সেখানে না পাও? হযরত মুয়াজ (রা.) বলেনÑফাবি সুন্নাতি রাসুলিল্লাহ, অর্থাৎ সুন্নাতে রাসুল (স.) দিয়ে। অতঃপর হযরত রাসুল (স.) জিজ্ঞাস করেনÑফাইল্লাম তাজিদ, অর্থাৎ যদি তাতেও না পাও? হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেনÑইজতাহিদু বি’রায়ে, অর্থাৎ তখন আমি নিজে ইজতেহাদ করবো। তখন হযরত রাসুল (স.) এই দোয়া করেন হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) জন্য-আলহামদু লিল্লাহিল’লাজি ওয়াফ্ফাকা রাসুলা রাসুলিহি বিমা ইয়রদা বিহী রাসুলুহু। অর্থাৎ সকল প্রসংশা ঐ আল্লাহর তিনি তাঁর রাসুলের রাসুল তথা প্রতিনিধিকে এমন পন্থা অবলম্বনের তাওফিক দিয়েছেন-যে ব্যাপারে তাঁর রাসুল সন্তুষ্ট আছেন।(মুসনাদে আহমদ, নুরুল আনোয়ার, পৃষ্টা ২২৪)। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, যদি কোরআন-হাদিসে কোন বিষয় স্পষ্ট না থাকে তবে সে বিষয়ে কোরআন-হাদিস ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমতি দিয়ে মূলত কিয়াসের নীতি এবং অনুমতি দিয়েছিলেন হযরত নবি করিম (স.)। কিয়ামত পর্যন্ত এই নীতিটাই প্রযোজ্য। তা ছাড়া হযরত রাসুল (স.)এর যুগে আজকের মতো ফেকাহের কোন প্রয়োজন ছিলো না। সেই সময়ের ফেকাহকে বলা হতো চিন্তা-বিবেচনা ও ইজতিহাদ অ-নির্ভরশীল ফিকাহ, আর ঐ ফিকাহের একমাত্র উৎস ছিলো ‘ওহী-এ-মতলু’ । হযরত রাসুল (স.)এর জ্ঞান দলিল, প্রমাণ, চিন্তা, গবেষণা দিয়ে অর্জিত হয়নি, তাঁর জ্ঞান ছিলো আল্লাহর কাছ থেকে ওহীর মাধ্যমে পাওয়া। এজন্যই তিনিকে ফকিহ বলা যাবে না। সেই সময়ে প্রতিটি ঘটনার সমাধান হতো ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর প থেকে। সাহাবায়ে কেরামের কাছে ‘ওহী-এ-মতলু’ আসতো না, তবে তাদের সামনেই ছিলেন ওহীর বার্তাবাহক নবি ও রাসুল (স.)। ‘ওহী-এ-মতলু’ এবং ‘ওহী-এ-গয়ের মতলু’ এই দুই ওহীর ভিত্তিতে হযরত সাহাবায়ে কেরামের সময়ে মূলত ফিকাহ শাস্ত্রের যাত্রা শুরু। হযরত সাহাবাদের সময়ে ফকিহ ছিলেন-হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত যয়েদ ইবনে সাবিত (রা.), উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)। আর তাদের ফিকার মূল দর্শন ছিলো ইবাদত বা হুক্কুল্লা এবং মুয়ামিলাত বা হুক্কুল ইবাদ। আজও এই দর্শনের ভিত্তিতে যারা আছেন আমরাতো তাদেরকেই আমাদের আকাবির মনে করছি। তাবিজÑকবজকে হাদিসে রাসুল(স.) শিরক ঘোষণা করছে বলেই আমরা এটাকে শিরক বলছি। এটা কোন প্রকারের স্থূল জ্ঞান কিংবা গাঢ় জ্ঞানের বিষয় নয়। এটা ঈমান এবং আকাইদের বিষয়। আমরা কেনো তাবিজকে শিরক বললাম কিন্তু চিকিৎসা পদ্ধতিকে শিরক বললাম না? বন্ধু ইবনে তায়্যিবের এটাও একটি প্রশ্ন। আরে ভাই, হাদিস যদি চিকিৎসাকে হালাল বলে আর তাবিজকে বলে শিরক বা হারাম, তবে আমাদের করার কি আছে? এটাতো আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (স.)এর বিষয়। আমি তাবিজের বিরুদ্ধে ‘কোরআন হাদিসের আলোকে তাবিজাত শিরক নয় কি?’ গ্রন্থে পাঁচটি হাদিস দিয়েছি, আর আপনি নিজের মতামতের ভিত্তিতে ইজমালী জবাব বলে যে বক্তব্য দিলেন তাতে যদি একটি হাদিস থাকতো, কিংবা সাহস করে বলতে পারতেন এই পাচঁটির একটাও হাদিস নয়, তবে আমরা একটু চিন্তিত হয়ে যেতাম। আপনি যদি হযরত রাসুল (স.)এর পাঁচটি হাদিসের মোকাবেলায় নিজের একটু মতামত কিংবা বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তবে কাদিয়ানি, মুতাজিলা কিংবা বাহায়ীদের অপরাধটা কি? কোন কোন আলেমেরে মতের সাথে আমার মতের পার্থক্যকে আপনি জঘণ্য অপরাধ ভাবলেন, অথচ আপনার বক্তব্য স্বয়ং হযরত রাসুল(স.)এর হাদিসের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, আর আপনি উল্টো নিজকে গাঢ় জ্ঞানী ভাবছেন, তা সম্পূর্ণ অনুচিৎ বন্ধু, তা সম্পূর্ণ অনুচিৎ। শরিয়তের এই সাধারণ উসুল নিশ্চয় আপনার জানা আছে যে, ‘ইবাদত’ নামক কোন কাজ যদি কোন মানুষকে মঙ্গলাত্মক কাজ থেকে বিরত রাখে তবে তা ‘ইবাদত’ নয়। আর মনে রাখবেন, যে জ্ঞানে সত্য নেই সে জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান নয়, এটা মূলত জ্ঞানের নামে প্রতারণা। চিকিৎসার আমল হযরত রাসুল (স.) এবং সাহাবাদের মধ্যে ছিলো, তাই আমরা চিকিৎসাকে শিরক বা হারাম মনে করি না। তাবিজকে রাসুল(স.) শিরক বলেছেন, তাই আমরা তাকে শিরক মনে করি। এটা মুদারাবা আর সুদের মতো বিষয়। কিংবা কা’বা ঘরের কালো পাথরে চুম্বনের মতো। ইসলামের দৃষ্টিতে মুদারাবা অর্থাৎ ব্যবসা হালাল শুধু নয়, ফরজ বলা হয়েছে। আর সুদকে বলা হয়েছে জঘণ্যতম হারাম। কেউ যদি সুদকে ব্যবসা মনে করে, আর যদি তা হয় ভুল বশত মনে করা তবে তাকে শরিয়তের ভাষায় ফাসেক বলা যাবে, আর যদি জেনে-বুঝে গাট্টামিবশত মনে করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। ইবাদতের নিয়তে সাধারণ পাথরে চুম্বন করা শিরক, কিন্তু কা’বার কালো পাথরে চুম্বন করা বরকতের কাজ। বোখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) কা’বার কালো পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেনÑ‘হে পাথর, তুমি আমার কাছে পাথর ছাড়া আর কিছু নয়। আমি তোমাকে কোনদিন চুম্বন করতাম না যদি আমার প্রিয় রাসুল (স.) তোমাকে চুম্বন না করতেন।’ এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন মাসআলায় এই ভিন্নতা কেনো? উত্তরে আমরা সহজভাবে কিছু যুক্তি দেখাতে পারি, কিন্তু এই যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বেও মূল উত্তর হলো-আল্লাহ এবং রাসুল এইভাবেই বিধান করে দিয়েছেন। তেমনি তাবিজ-কবজ এবং চিকিৎসার বিষয়টিও। তাই আমরা এখানে ওমর (রা.)এর মতো বলতে পারি-যদি রাসুল (স.) চিকিৎসাকে শিরক বলতেন, তবে আমরাও শিরক মনে করতাম। হাদিসের সবগুলো কিতাবেইতো ‘চিকিৎসা অধ্যায়’ আছে, খুলে দেখুন কি বলেছেন হযরত রাসুল (স.) চিকিৎসা এবং তাবিজ সম্পর্কে। চিকিৎসা সম্পর্কে নবি করিম (স.) এর হাদিস স্পষ্ট-‘হযরত উসামা ইবনে শারিক (রা.) বলেন, একবার বেদুঈন আরবরা বললো, হে আল্লার রাসুল! আমরা কি চিকিৎসা করাবো না? হযরত রাসুল (স.) বললেন, হাঁ, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা করাবে, আল্লাহ পাক এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি যার কোন প্রতিষেধক তিনি রাখেননি। কিন্তু একটি রোগের কোন প্রতিষেধক নেই। তারা জানতে চাইলেন, ইয়া রাসুলল্লাহ, সেটি কি? তিনি বললেন, বার্ধক্য।( তিরমিজি শরিফ)। ইমাম আবু ঈসা আত-তিরমিজি (র.) এই হাদিসকে হাসান এবং সহীহ বলেছেন।সহীহ হাদিসের গ্রন্থ তিরমিজি শরিফে মহা নবি (স.) এর অনেক হাদিস আছে যেগুলোতে অনেকগুলো চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাবিজের বিরুদ্ধে কথা আছে। এই আলোচনার শেষ দিকে তাবিজের বিরুদ্ধে এবং চিকিৎসা কিংবা শিরকমুক্ত ঝাড়-ফুঁকের পে হযরত মহা নবি (স.)এর আরো কিছু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। শিরকমুক্ত ঝাড়-ফুঁক বৈধ সম্পর্কিত আমার বক্তব্যকে নকল করে প্রিয়বন্ধু ইবনে তায়্যিব একস্থানে এসে যখন বলেন-‘ লেখক আপন বইয়ের স্থানে স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, তাবিজাত শিরক হলেও ঝাড়-ফুঁক বৈধ। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসে তো ঝাড়-ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে। তা হলে ঝাড়-ফুঁক বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে তাবিজাত বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রেও সে ব্যাখ্যা প্রজোয্য হবে।’( আল-হিলাল,২০০৭-৮, পৃষ্টা ৯৫)। এই হাদিস দিয়ে ঝাড়-ফুঁক শিরক প্রমানিত হওয়ার পর ঝাড়-ফুঁক বৈধ হলো কী ভাবে, এটা আপনার প্রশ্ন। আর আপনি মনে করেন ঝাড়-ফুঁক যে কারণে বৈধ সেই কারণে তাবিজও বৈধ। প্রিয় বন্ধু, হাদিসে স্পষ্ট আছে শিরকমুক্ত ঝাড়-ফুঁক বৈধ, আর শিরকযুক্ত ঝাড়-ফুঁক অবৈধ। অথচ তাবিজ বৈধ হওয়ার পক্ষ এমন একটি হাদিসও নেই। আর যখন স্পষ্ট করে বলা হয় শিরকমুক্ত ‘রাকিয়া’ বৈধ এবং ‘তামিমা’ অবৈধ তখন বিষয়টা পরিস্কার এবং পৃথক হয়ে যায়। যদি ‘রাকিয়া’ অর্থাৎ ঝাড়-ফুঁকের মতো শিরকমুক্ত ‘তামিমা’ অর্থাৎ তাবিজ-কবজকে পৃথক করে বৈধ বলা হতো তবে আমাদের কোন কথাই থাকতো না। আম অর্থাৎ সাধারণ এবং খাস অর্থাৎ বিশেষের মাসআলা নিশ্চয় আমার প্রিয় বন্ধু ইবনে তায়্যিবের অজানা নয়। এরপর আশা করি তিনির এবিষয়ে আর বিভ্রান্তি থাকবে না। প্রিয় বন্ধুকে স্মরণ রাখতে হবে, কোন হাদিসের খণ্ডাংশ বর্ণনা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কোন অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। ঝাড়-ফুঁক বৈধ এবং তাবিজ-কবজ শিরক, এবিষয়ে হাদিস আছে এবং হাদিসে এভাবেই পৃথক করে বলা হয়েছে। একজন মুসলমানের জন্য হাদিসের দলিলটুকুই যথেষ্ট। আপনি তবুও যদি প্রশ্ন করেন, ঝাড়-ফুঁক বৈধ আর তাবিজ অবৈধ কেনো? আমরা সহজ উত্তর বলবো-হযরত রাসুল (স.) এসম্পর্কে ভালো জানতেন, আমরা এই কার্যের কারণ জানি না। যাদের প্রয়োজন হয় তারা কারণ খুঁজে দেখলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আল্লামা শামী (রহ.)র বক্তব্য সম্পর্কে নতুন করে আর হয়তো বলার প্রয়োজন নেই। প্রথমত তিনি হানাফি মাজহাবের ফকিহ, আর আমরা ইতোমধ্যে কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)এর বক্তব্য আলোচনা করেছি। আল্লামা শামী(রহ.) ছিলেন ১২৫২ হিজরির লোক, আর আমরা হচ্ছি ১৪২৮ হিজরির লোক। তাঁর এবং আমাদের মধ্যখানে মাত্র ১৭৬ বছরের ব্যবধান আর হযরত নবি করিম (স.)এর সাথে তাঁর ব্যবধান প্রায় ১২৫২ বছর। তাহজিব-তামাদ্দুনের উত্তান পতনের ইতিহাসে ১২৫২ বছরের সামনে ১৭৬ বছর খুব একটা দিন নয়। আল্লামা শামী (রহ.) অবশ্যই কোন তাবিয়ী ছিলেন না, তিনি আমাদের কাছাকাছি সময়ের হানাফি মাযহাবের একজন ফকিহ ছিলেন। তাঁর ইজতেহাদেও ভুল হওয়ার সম্ভবনা আছে। তিনি নিজেইতো তাঁর ‘শহরে উকুদ রসমুল মুফতি’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘এমনও হতে পারে যে, বিশটি কিতাবে একটি মাসআলা ভুল আলোচিত হওয়ার পর তা শেষ পর্যন্ত শুদ্ধ হতে পারে। আর শুদ্ধটাই গ্রহণযোগ্য।’ এই পর্যন্ত আলোচনার পর আমার বিশ্বাস বন্ধু ইবনে তায়্যিব কিংবা অন্য যারা তাবিজ সম্পর্কে দ্বন্দ্বে আছেন, তারা দ্বান্দ্বিকতামুক্ত হয়েছেন। তবু যদি সন্দেহ কিংবা দ্বন্দ্ব না কাটে তবে আমি এখানে তাবিজ শিরক হওয়ার পে আরো কিছু হাদিস বর্ণনা করছি, যা একজন ঈমানদারের চোখ খুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ হতে পারে-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, তিন জিনিসের মধ্যে রোগের নিরাময় রয়েছে, শিংগা লাগানো, মধু পান করা অথবা উত্তপ্ত লোহা দিয়ে দাগ দেওয়া। তবে আমি আমার উম্মতকে দাগ থেকে নিষেধ করছি। (বোখারি শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩১৬)।হযরত আনাস (রা.) বলেন, কারো বদ নজর লাগলে , কোন বিষাক্ত প্রাণী দংশন করলে এবং পাঁজরে খুজলি উঠলে হযরত নবি করিম (স.) ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিতেন।(মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩২৬)।হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- কারো বদ নজর লাগলে হযরত নবি করিম(স.) ঝাড়-ফুঁকের নির্দেশ দিতেন।(মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩২৭, মুয়াত্তাফাররিক আলাইহি)।হযরত উম্মে সালমা বলেন, একদিন হযরত নবি করিম (স.) আমার ঘরে একটি মেয়ে দেখতে পেলেন যার চেহরায় (বদ নযরের) চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ চেহরাটি হলুদ রঙ ধারণ করেছে। তখন নবি করিম (স.) বললেন; এরজন্য ঝাড়-ফুঁক করো, কারণ তার উপর নযর লেগেছে।।( মুয়াত্তাফাররিক আলাইহি, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩২৮)। হযরত যাবের (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) ঝাড়-ফুঁক নিষেধ করেছেন। (এই নিষেধের পর) আমর ইবনে হাযমের বংশের কয়েকজন লোক এসে বললেন-ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের কাছে এমন একটি মন্ত্র আছে যা দিয়ে আমরা বিচ্ছুর দংশন ঝাড়-ফুঁক করে থাকি। অথচ আপনি মন্ত্র পড়াকে নিষেধ করে দিয়েছেন। অতঃপর তারা মন্ত্রটি নবি করিম (স.)কে পড়ে শুনাইলেন। তখন তিনি বললেন-এতে দোষের কিছু দেখছি না। এতএব, তোমাদের যে কেউ নিজের কোন ভাইয়ের কোন উপকার করতে পারে সে যেনো অবশ্যই তার উপকার করে।(মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩২৯)। এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আকাবির উলামাগণ বলেন, ঝাড়-ফুঁকে শিরক নয়, তা মোবাহ, অর্থাৎ বৈধ।হযরত আওফ ইবনে মালেক আশজায়ি (রা.) বলেন, জাহেলি যুগে আমরা মন্ত্র পড়ে ঝাড়-ফুঁক করতাম। (ইসলাম গ্রহণের পর) আমরা জিজ্ঞাস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের এই সকল মন্ত্র সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তখন তিনি বললে: আচ্ছা, তোমাদের মন্ত্রগুলো আমাকে পড়ে শোনাও। (তবে কথা হলো) মন্ত্র দিয়ে ঝাড়-ফুঁকে কোন আপত্তি নেই যদি তাতে শিরক না থাকে।(মুসলিম শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৩০)।হযরত মুগীরা (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) বলেছেন- যে ব্যাক্তি শরীর দাগায় অথবা ঝাড়-ফুঁক করায় সে আল্লাহর তাওয়াক্কুল থেকে দূরে সরে পড়ে।(মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি শরিফ, ইবনে মাজাহ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৫৫।)ইমাম তিরমিজি (র.) লিখেছেন, এই বিষয়ে ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস এবং ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে হাদিস আছে। তবে তাঁর মতে হাদিসটি হাসান এবং গরিব। এই হাদিসে তাওয়াক্কুলের কথা বলা হয়েছে. অবৈধ বলা হয়নি। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আইন এক জিনিষ আর আদব অন্য জিনিষ। তাওয়াক্কুল বাদ গেলে কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে না, কিন্তু আইন ভঙ্গ হলে শাস্তি দেওয়া হবে। এই হাদিসের পাশাপাশি তিরমিজি শরিফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আমরা দেখতে পাই যেখানে নবি করিম (স.) জ্বর, বদ-নজর, কারবংকলের ক্ষেত্রে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন। হযরত ঈসা ইবনে হামযা (রা.) বলেন, আমি একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উকাইমের নিকট গেলাম। তাঁর শরিরে লাল ফোসকা পড়ে আছে। আমি বললাম-আপনি তাবিজ ব্যবহার করবেন না? উত্তরে তিনি বললেন-আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। কারণ, রাসুল (স.) বলেছেন- যে ব্যক্তি এর কোন কিছু ব্যবহার করে তাকে তার প্রতি সোপর্দ করে দেওয়া হবে।(আবু দাউদ শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৫৬)।হযরত ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) বলেছেন, বদ-নযর কিংবা কোন বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের বেলাই ঝাড়-ফুঁক রয়েছে।( হযরত বোরাইদাহ (রা.) থেকে এই হাদিসটি মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন, মেশকাত শরিফ- হাদিস নং ৪৩৫৭)।হযরত আনাস (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) বলেন, বদ-নযর লাগা, বিষাক্ত প্রাণীর দংশন করা এবং রক্ত ঝরার জন্য রয়েছে ঝাড়-ফুঁক।( আবুদাউদ শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৫৮)।হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রা.) বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! জা’ফর (তাইয়্যার)-এর সন্তানদের উপর দ্রুত বদ-নজর লেগে যায়। সুতরাং আমি কি তাদেরকে ঝাড়-ফুঁক করাবো? তিনি বললেন-হাঁ, কেননা, যদি কোন জিনিস তকদিরের অগ্রগামী হতে পারতো তবে বদ-নজরই তার অগ্রগামি হতো।(মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি-নং ২০৬৫, ইবনে মাজাহ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৫৯)। এই বিষয়ে ইমরান ইবনে হোসাইন এবং বুরায়দা (রা.) থেকেও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি হাসান এবং সহীহ।হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) জ্বীন এবং মানুষের চোখ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন। মুয়া’ব্বাযাতাইন (সুরা ফালাক ও নাস) নাজিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। আর যখন এই সুরা দুইটি নাজিল হলো তখন উক্ত সুরা দুইটি দিয়ে পানাহ চাইতে লাগলেন এবং বাকি সবকিছু পরিত্যাগ করেন।( তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৬৩)। হযরত আলী (রা.) বলেন, কোন এক রাতে হযরত নবি করিম (স.) নামাজ পড়া অসস্থায় জমিনে হাত রাখতেই একটি বিচ্ছু তাঁকে দংশন করে। তৎকণাৎ রাসুল (স.) জুতা দিয়ে বিচ্ছুটিকে মেরে ফেলেন। অতঃপর নামাজ শেষে বললেন, বিচ্ছুটির উপর আল্লাহর লানত হোক। সে নামাজি, বেনামাজি অথবা বলেছেন, নবি কিংবা অন্য কাউকে ছাড়ে না। অতঃপর তিনি লবন এবং পানি চেয়ে নিয়ে এগুলোকে একটি পাত্রে মিশিয়ে আঙ্গুলির দংশিত স্থানে পানি ঢেলে মুছতে থাকেন এবং ‘মুয়াব্বাযাতাইন’ সুরা দুটি দিয়ে ঝাড়তে থাকেন।’ (বায়হাকি, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৬৫)।হযরত উসমান ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাওহাব(র.) বলেন, পরিবারের লোকেরা পানির একটি পেয়ালা দিয়ে আমাকে হযরত উম্মে সালমার নিকট পাঠাইলেন। তখনকার নিয়ম ছিলো, যদি কারো উপর বদ-নজর লাগতো কিংবা অন্য কোন অসুখ হতো, তখন উম্মে সালমার নিকট একটি টব পাটিয়ে দিতেন। তিনি হযরত নবি করিম(স.)এর কিছু পশম মোবারক বের করতেন, যা তিনি একটি রূপার কৌটার ভেতর রাখতেন। অতঃপর তিনি এই পশম পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিতেন এবং পানি রোগিকে পান করানো হতো। বর্ণনাকারি বলেন, আমি রূপার সেই নলটির মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম তাতে (হুজুর স. এর) কয়েকটি লাল বর্ণের পশম রয়েছে।(বোখারি শরিফ, মেশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৬৬)।আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, হযরত নবি করিম (স.) বলেছেন-নিরাময়কারি দুটি জিনিষকে তোমরা আঁকড়িয়ে ধর। তা হলো মধু এবং কোরআন। (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি, মিশকাত শরিফ-হাদিস নং ৪৩৬৯)।মোহাম্মদ ইবন বাশ্শার (র.).......ইমরান ইবন হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুল (স.) দাগ দিতে নিষেধ করেছেন। ( তিরমিজি, হা. ন.-২০৫৫)। ইমাম আবু ঈসা আত-তিরমিজি (র.) এই হাদিসকে হাসান ও সহীহ বলেছেন। এই বিষয়ে ইবনে মাসউদ, উকবা ইবনে আমির ও ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে হাদিস থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আবদা ইবনে আব্দুল্লাহ খুযাই (র.).....হযরত আনাস (রা.) থেকে বলেন, হযরত রাসুল (স.) জ্বর, বদ-নজর এবং কারবংকলের ক্ষেত্রে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন।( তিরমিজি, ২০৬২)। এই হাদিস মাহমুদ ইবনে গায়লান (র.)...... হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকেও বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজি (র.) লিখেছেন, এই বিষয়ে বুরায়দা, ইমরান ইবনে হোসাইন, জাবির, আয়েশা, তালক ইবনে আলী, আমর ইবনে হাযম(রা.) প্রমূখ থেকেও হাদিস বর্ণিত হয়েছে।ইবনে আবু উমার (র.).....ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত রাসুল (স.) বলেছেন: বদ-নজর অথবা জ্বর ছাড়া অন্য ক্ষেত্র ঝাড়-ফুঁক নেই।(তিরমিজি, ২০৬৩)।ইমাম তিরমিজি (র.) লিখেছেন, শুবা (র.) এই হাদিসকে শা’বী---বুরায়দা (রা.)সূত্রে বর্ণনা করেছেন।হিসাম ইবনে কূফি(র.).....আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত রাসুল (স.) মুআওওয়াযাতায়ন (সুরা ফালাক ও নাস) নাজিল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বদ-নজর থেকে পানাহ চাইতেন। এই সুরাদ্বয় নাজিল হওয়ার পর বাকি সব ছেড়ে এই দু’টিকে গ্রহণ করেন।(তিরমিজি, নং ২০৬৪)। এবিষয়ে হযরত আনাস (রা.) থেকেও একটি হাদিস রয়েছে। ইমাম আবু ঈসা তিরমিজি (র.)এর মতে এই হাদিসটি সহীহ এবং গরিব।হযরত কুতায়বা(র.).....আবু মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন, হযরত রাসুল (স.) নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন কুকুর বিক্রির মূল্য, ব্যভিচারিনির উপার্জন এবং গণকের কামাইকে।(তিরমিজি, নং ২০৭৭)। ইমাম তিরমিজি(র.)এর মতে হাদিসটি সহীহ এবং হাসান।হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাদ্দুওয়াহ(র.) ..... হযরত ঈসা, ইনি হলেন ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা (র.) থেকে বর্ণনা করেন- আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উকায়েম আবু মা’বাদ জুহানি(র.)কে দেখতে গেলাম। তিনি বিষাক্ত ফোঁড়ায় আক্রান্ত ছিলেন। বললাম, কোন তাবিজ লটকিয়ে নিলেন না? তিনি বললেন, মৃত্যুতো এর থেকে নিকটে। হযরত নবি করিম (স.) বলেছেন, কেউ যদি কিছু লটকায় তবে তাকে সেদিকেই সোপর্দ করে দেওয়া হয়।( তিরমিজি, নং ২০৭৮)। হযরত নবি করিম (স.) এই হাদিসগুলো সহীহ। তাবিজ-কবজের বিরুদ্ধে এতো সহীহ হাদিস থাকতে আমরা কী বন্ধু ইবনে তায়্যিব কিংবা অন্য কারো কিয়াসকে মেনে নিতে পারি? ফাঁক রেখে কথা বলে শুধু শুধু আকাবির তাবেয়ীদেরকে তাবিজের সাথে জাড়ানো কি উচিৎ? কোন কোন সময় মানুষ পূণ্যের নিয়তে পাপ করে, আমার বন্ধু ইবনে তায়্যিব আকাবিরদের কথার মর্মার্থ না বুঝে তাদের প নিতে গিয়ে মূলত তাদেরকে বদনামী করছেন। যদিও এই বদনামী করাটা তাঁর মূল উদ্দেশ্য নয়। সবশেষে মহান আল্লাহ পাকের কাছে আমার নিজের এবং গোটা মানব জাতির হেদায়াত প্রার্থনা করছি।