রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

নব্বই'র দশকে সিলেটের সাহিত্য ও কয়েকজন স্বপ্নচারী

সিলেটে আমরা কিছু তরুণ লেখক এক সময় আড্ডা দিতাম জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনস্থ সাথী লাইব্রেরীতে। দীর্ঘদিন এ আসর বেশ জমজমাটই ছিলো। আমাদের আড্ডার অনেকই বর্তমানে সাহিত্যের বিভিন্ন দিকে কম-বেশি নিজস্ব একটা অবস্থান করে নিয়েছেন। সাথী লাইব্রেরীর আড্ডায় আমরা যারা নিয়মিত অংশ নিতাম তাদের মধ্যে শাহ শামীম, সরওয়ার চৌধুরী, জিয়া উদ্দিন, শামীম শাহান, মুস্তাক আহমদ দীন, ফকির ইলিয়াস, জফির সেতু, মাহবুব লীলেন, শামসুন নুর, এ টি এম কায়সার, আহমদ মিনহাজ, জগলু চৌধুরী প্রমূখ। মাঝে মধ্যে আসতেন আহমদ ময়েজ, রকীব আল হাফিজ, আমান উদ্দিন আমান, শাহ তোফায়েল, মতিউল ইসলাম মতিন প্রমূখ। ওরা সবাই নব্বই দশকের সাহিত্য কর্মী। আশি দশকের কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার মাঝেমধ্যে আসতেন। ঘটনাচক্রে দু একদিন ষাট দশকের কবি দিলওয়ার এসেছেন। যদিও আমি কবিকে দেশ,দশক, অঞ্চল কিংবা অন্য কোনো বিশেষণে ভাগ করার পক্ষে নয়, তবু এখানে করে নিলাম প্রচলিত প্রদ্ধতিতে। আমরা যারা তখন আড্ডা দিতাম ওদের প্রায় সবাই তখন টসবগে তরুণ। সময়টা ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আমাদের অনেকেরই লেখা তখন নিয়মিত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। আবার কারো কারো বইও প্রকাশিত হয়েগেছে। কেউ কেউ আবার সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি স্থানীয় কিংবা জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছেন। কারো কারো সম্পাদনায় লিটল ম্যাগ প্রকাশ হচ্ছে। মোট কথা আমাদের আড্ডার কোনো স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী সদস্যকে ছোট করে দেখার সুযোগ ছিলো না। সাহিত্যকে যদি বলা হয় সমাজের বিবেক তবে আমরা ছিলাম বিবেকের ধারক-বাহক। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন ( ১৫৬১Ñ১৬২৬) বলেছেন-`জবফরহম সধরশবঃয ধ ঋঁষষ সধহ, পড়হভধৎধহহপব ধ ৎবধফু সধহ ধহফ ৎিরঃরহম ধ বীধপঃ সধহ.' অর্থৎ পড়ার মাধ্যমে মানুষ পরিপূর্ণ হয়, আলোচনার মাধ্যমে সর্বদা জাগ্রত থাকে এবং লেখার মাধ্যমে মানুষ হয় সাধক। বাস্তবে আমাদের আড্ডার প্রায় সকল সদস্যের মধ্যে সেদিন এই বৈশিষ্ট্য ছিলো। বই পড়া নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। প্রতিটি আড্ডার আসরে যুক্তি-তর্কের খই ফূটতো। তবে আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো সাহিত্য। ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস- সাহিত্যে প্রধানত এই পাঁচটি দিক। প্রতিটি দিকই সাহিত্যের সঞ্চিত ভান্ডারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সামন্য দৃষ্টিপাত করে যাবো মাত্র। প্রথমে কবিতার কথা বলা যায়। কবিতা সাহিত্যের প্রধান শক্তিশালী বিষয়। বাংলা সাহিত্য জগতে কবিতা এক অমূল্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক সময় পর্যন্ত সমান উৎকর্ষ সাধনের মধ্যদিয়ে কবিতা উত্তরাধুনিক কাল পর্যন্ত তাঁর উচ্চ আসন সমুন্নত রাখতে পেরেছে। বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এসেছে কবিতায়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ যতোটুকু আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় গড়ে উঠেছে আধুনিক যুগটা গড়ে উঠেছে ততটুকু সাংঘর্ষিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। প্রকৃত অর্থে আধুনিক যুগ মানে আমাদের পরাধিনতা, পলাশির আম বাগানে নবাব সিরাজের লাশ, স্বদেশী কৃষকদের জমিনে বিদেশী শোষকদের খমচা মারা ইত্যাদি। অতঃপর আধুনিকতার জন্ম। আধুনিকতা মানেই প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্যের কর্তৃত্ব নিঃশর্ত মেনে নেওয়া, নতুবা বুক পেতে বুলেট-বোমার জন্য অপেক্ষা করা। ইংরেজযুগে আমাদের ভারতবর্ষে ইংরেজদের তৈরীকৃত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে আধুনিকতার আগমন ঘটে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক সময়ের কবিরা পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারাকে অনুসরণ করে বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার রূপ দিয়েছেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই ধারণ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে বলে আমরা মনে করি। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বলতে হবে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম সফলতম ব্যক্তিত্ব কিংবা গুরু। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম। অতঃপর জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে প্রমূখ। শেষদিকে শামসুর রহমান, আল-মাহমুদ প্রমূখ। এখানে শুরু থেকে একটা চেইন অফ কামান্ড আছে। এই কামান্ডটা যেমন আছে কালিক, তেমনি আছে ব্যক্তিক। যারা আধুনিকতার নামে এখানের মাটি আর মানুষের সাথে চেইন অফ কামান্ড রাখেননি, তারা শেকড়হীন আবর্জনার মতো হারিয়ে গেছেন সময়ের ব্যবধানে। স্বদেশী ধারার সংমিশ্রনে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক সাহিত্য আজো দাঁড়িয়ে আছে এবং এটাই মূলত বাংলা সাহিত্যের চেইন অফ কামান্ড। আজকে বাংলা সাহিত্য যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার শেকড়ে যেমন চর্যাপদের জল লেগেছে তেমনি পরবর্তী প্রতিটি সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকৃত সাহিত্যের। আজকেও যা সামনের দিকে এগুচ্ছে তাতেও আছে নবীন ও প্রবীনদের কৃতিত্ব। তবে একটি কথা দুঃখজনক হলেও সত্য-আমাদের সাহিত্য যতটুকু অগ্রসর হয়েছে ততটুকু আমরা জাতি হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারিনি। ফলে আধুনিক কবিতা আমাদের সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এক্ষেত্রে ছড়া কিংবা গান এখনো মানুষের মন জয় করে আছে। ছড়ার ছন্দ এবং গানের সুর এখনো মানুষের কাছে খুব প্রিয়। সাহিত্যের অন্যান্য দিকের তুলনায় প্রবন্ধ সাহিত্য খুবই শ্রমসাধ্য। প্রবন্ধে লেখকদের সামাজিক চেতনা ও মননচর্চার স্বাক্ষর উজ্জ্বল হয়ে উঠে। একজন প্রাবন্ধিককে হতে হয় যুক্তিবাদি, বাস্তবসম্মত এবং বিজ্ঞান মনস্ক বিশ্লেষক। বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবন্ধের বয়স তেমন নয়। তবে বিষয়-বস্তু ও বিশ্লেষনের দিক দিয়ে তা বর্তমানে সমৃদ্ধশীল। আমাদের জাতীয় জীবনের ধ্যান-ধারণা, কামনা-বাসনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবন, ইতিহাস, ভ্রমণ, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানের বিভিন্ন কথা ইত্যাদি বাংলা প্রবন্ধে ইতোমধ্যে বিষয়ীভূত হয়েছে। তবে বাংলা প্রবন্ধে সাহিত্য বিষয়ক গবেষণাই বেশি দেখা যায়। আধুনিক সাহিত্যের আরেকটি বিষয় হলো উপন্যাস বা কথা সাহিত্য। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন `প্যারিচাঁদ মিত্র', উপন্যাসের নাম ছিলো-` আলালের ঘরের দুলাল'। বর্তমানে উপন্যাস সাহিত্য বাংলাদেশে সবচাইতে জনপ্রিয়। ইতিমধ্যে ছোট গল্প ও একটা অবস্থান করে নিয়েছে। মূলত গল্প এবং উপন্যাস দুটাই কথা সাহিত্য। সাহিত্যের ভাষায় আমরা ছোটগল্প যাকে বলছি তা মূলত কবিতা এবং গীতির মতো জীবনের খণ্ডিত চিত্র বহন করে থাকে। বাংলা সাহিত্যের সার্থক ছোটগল্পের জনক কবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে -` যা শেষ হয়েও শেষ হইলো না তাহাই ছোটগল্প'। ছোটগল্পে জীবনের তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষন, ঘটনা এবং চরিত্রের বহুল পরিচয় ঘটানোর সুযোগ থাকে না। জীবনের ঘটে যাওয়া দু-একটি চরিত্রের দু-একটি ঘটনার মধ্যে একটি ছোটগল্প মাঝ পথে শুরু হয়ে মাঝ পথে শেষ হয়ে যায়। যাই হোক, সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য পাঁচ দিকের ধারক-বাহকই ছিলাম আমরা ঐ আড্ডায়। ফলে সাহিত্যের প্রত্যেক দিকই আমাদের আড্ডায় আলোচিত হতো। মাঝেমধ্যে রাজনীতিটাও এসে যেতো ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। রাজনীতির দিকে কিন্তু আমরা ভিন্নমতের ছিলাম। ইসলাম, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সাম্যবাদ, পূঁজিবাদ ইত্যাদি সকল মজহবের রাজনৈতিক চিন্তাশীল দলের মৌন, গৌন কিংবা সরাসরি জড়িত অনেকই ছিলেন আমাদের আসরে। রাজনীতি নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচন্ড বিতর্ক জমে উঠতো। আমরা তর্ক-বিতর্কে যুক্তি দিয়ে একে অন্যকে আঘাত করেছি কিন্তু হিংসা বা প্রতিহিংসায় ঝগড়া করিনি। সবাই যার যার দর্শনের পক্ষে তাত্ত্বিক যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। প্রতিপক্ষকে আঘাত করেছি তাদের প্রচারিত গ্রন্থ সমূহ থেকে। ফলে রাজনীতি নিয়ে আমাদের প্রচুর অধ্যয়ন হয়ে যেতো। তবে আমাদের প্রায়ই শেষ সিদ্ধান্ত ছিলো আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে। জাতীয় রাজনীতি ছাড়াও আমরা আন্তর্জাতিক বিষয়াদী নিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে যেতাম। যেহেতু আমরা ছিলাম সবাই বয়সে তরুণ, তাই নারী, ভালোবাসা ইত্যাদি কিছুই বাদ যায়নি। মোটকথা বেকনের সেই উক্তি অনুযায়ী আমাদের আড্ডার আসর ছিলো পরিপূর্ণ, জাগ্রত এবং সাধক মানুষদের আড্ডার আসর। তাই আমাদের সেই আড্ডার আসরকে ছোট করে দেখার সুযোগ ছিলো না। আমরা যে বয়সে সাথী লাইব্রেরীতে আড্ডা দিয়েছি সেই বয়সের তরুণদের মধ্যে বর্তমানে কি এরকমের ভিন্নমতাবলম্ভী আড্ডার আসর জমে? হয়তো জমে, হয়তো জমে না। তখনও যে খুব একটা জমতো তা কিন্তু নয়। আমরা ছিলাম ব্যতিক্রম। আজও আমরা সুযোগ পেলে দেশ-বিদেশে জমতে পারি অথবা জমে যাই। এই আড্ডায় আমরা যারাই ছিলাম প্রায় সবার একটা উদার মন ছিলো। আমরা আজও দাঁড়িয়ে আছি সাহিত্যের পথে, প্রায় সবাই। শাহ শামীম, শামীম শাহান, আহমদ ময়েজ, আমান উদ্দিন আমান, এ টি এম কয়েস, ফারূক আহমদ রনি প্রমূখরা বর্তমানে ইংল্যান্ডে আছেন। আমিও ছিলাম ইংল্যান্ডে, তবে `না ঘর কা না ঘাটকা' আবস্থা কাটিয়ে বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশেই আছি। তবে বর্তমানে ইংল্যান্ডও যে আমার দেশ তা অস্বীকার করবো না। মোশতাক আহমদ দীন, আহমদ মিনহাজ, জফির সেতু, মাহবুব লিলেন, মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন, রকীব আল হাফিজ প্রমূখরা দেশে আছেন। মতিউল ইসলাম মতিন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে দেশে ফিরেছেন। আমাদের সবারই কমবেশি বই বর্তমান বাজারে আছে। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘আমি এক নস্ট যুবক’ দিয়ে ফারুক আহমদ রনির প্রকাশনার জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিলো। গ্রন্থটি হলো কবিতার। আমরা সবাই যখন নিজেরা নিজেদেরকে অতি ভালো মানুষ বলে প্রচার করতে আনন্দ অনুভব করি তখন রনি নিজেকে একজন নস্ট যুবক বলে বই প্রকাশ করে মোটামুটি একটা চমক লাগিয়ে দেয়। আমাকে একটা কপি তখন রনি দিয়েছিলো যা এখনও আমার সংরক্ষনে আছে। আমরা আড্ডার আসরে রনিকে দীর্ঘদিন নস্ট যুবক বলেই ডাকতাম। রনি প্রায়ই বিয়ানীবাজার থেকে এসে আমাদের আড্ডায় অংশ নিতো। ` জ্বলছি অলীক অনলে' নামে রনির আরেকটা বইয়ের সংবাদ আমার অবগতিতে থাকলেও বইটি আমার হাতে পৌছেনি। আমান উদ্দিন আমান একজন মাষ্টার মানুষ। দেশে থাকতে গোলাপগন্জের এক স্কুলে মাষ্টারী করতেন। বর্তমানে ইংল্যান্ডের বেড ফোর্ডের এক প্রাইমারী স্কুলে আছেন। আমান ভাই সর্বদাই দার্শনিক প্রকৃতির লোক। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আমান উদ্দিন আমানের ` দিলওয়ার: কাব্য ধর্ম ও মানব দর্শন', `বিশ্ব মনীষীদের দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (স.)'এবং ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ` হাছন রাজার উচ্চানুভূতি প্রেম ও বৈরাগ্যভাবনা' গ্রন্থদ্বয় সূধী মহলে তাকে তরুণ বয়সে একজন চিন্তক হিসেবে পরিচিত করে দিয়েছিলো। আমান ভাই মাঝেমধ্যে আসতেন গোলাপগন্জ থেকে আমাদের আড্ডায়। বর্তমানে তিনি ইংল্যান্ড আছেন এবং তার আরো কিছু বই প্রকাশ হয়েছে। মোস্তাক আহমাদ দীন সেই সময় ছিলো জগন্নাথপুরে এক কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। তবে বেশির ভাগ সময়ই থাকতো সিলেটে। তখনও তার কবিতায় শক্তি ছিলো। মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি মোশতাক স্কুল-কলেজের দিকেও এগিয়ে যায়। আমাদের আড্ডার আসরে মোশতাক আসতো টুপি মাথায়-পান্জাবী গায়ে। তবে সে সর্বদাই শান্ত প্রকৃতির লোক। জ্ঞানচর্চায় মোশতাকের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে। মোশতাকের বাবা একজন আলেম ছিলেন। মোস্তাকের মামা গবেষণায় বাংলা একাডেমীর পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী। এই সব মোস্তাকের ঐতিহ্য হলেও তার মূল পরিচয় বর্তমানে সে নিজেই। মোস্তাক আহমদ দীন নব্বই দশকের শক্তিশালী কবি বলে উভয় বাংলার কবিতার পাঠকরা স্বীকার করে নিয়েছেন। মোস্তাক এখনোও আগের মতো নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। সে যেমন কবিতায় তেমনি গবেষণায়, অনুবাদেও পিছিয়ে নেই। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘ কথা ও হাড়ের বেদনা’ নামে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশেই সে যেনো তার নিজের শক্তি প্রদর্শন করে নিয়েছে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত `জল ও ত্রিকালদর্শী' কাব্যগ্রন্থেও মোস্তাক আছে তার নিজের অব্যাহত ধারায়। অনুবাদ করেছে মোস্তাক `তারিখে জালালি' নাম দিয়ে নাসির উদ্দিন হায়দারের ফারসী গ্রন্থ `সুহেলে এমন' কে, মুহাম্মদ মবছির আলী চৌধুরীর উর্দুকৃত গ্রন্থ থেকে। গ্রন্থটি মূলত হযরত শাহ জালাল(র.)এর জীবনী। তাছাড়াও তার হাতে সম্পাদিত হয়েছে-পরার জমিন, অকূল নদীর ঢেউ এবং মাসিংনদীর তীরে ইত্যাদি গানের বই। মোস্তাক আহমদ দীন আরো কাজ করছে। আমরা তার ওপর আশবাদী। আমাদের আড্ডার আসরে প্রত্যেকেরই প্রত্যেকের সাথে আন্তরিকতা ছিলো। তারপরও কারো কারো ব্যক্তিগত বন্ধত্বি কারো কারো সাথে দেখা যেতো। জফির সেতু আর মাহবুব লিনেনের মধ্যে এমনি এক আন্তরিকতার কথা এখনও আমার স্মৃতিকে নাড়িয়ে যায়। কোন এক পরিক্ষার ফিস কলেজে জমা না দিয়ে জফির সেতু তার সম্পাদিত লিটেল ম্যাগ প্রকাশ করে। বিষয়টি প্রথমে সে গোপন রাখে। পরিক্ষার ফিস জমা দেয়ার যখন মিয়াদ শেষের দিকে তখন মাহবুব লিনেন বিষয়টি আমার সাথে আলোচনা করে। এইদিন বিকালে আমি, মাহবুব লিনেন আর জফির সেতু জিন্দাবাজারস্থ সমবায় ভবনের দ্বিতীয় তলার হোটেলে বসে বিষয়টি পর্যালোচনা করে জফির সেতুকে অনুরোধ করি টাকা না থাকলে কর্জ করে হলেও ফিস জমা দিয়ে পরিক্ষা দিতে। কর্জদাতা হিসাবে আমি আমার নিজের নাম প্রস্তাব করি। জফির সেতু জানায় সে ব্যবস্থা করতে পারবে। এরপর কি হয়েছিলো এখন আর আমার স্মরণে নেই। তবে সে শেষ পর্যন্ত পরিক্ষা দিয়েছে, তা বলতে পারি। বর্তমানে সে এম সি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার ` বহুবর্ণ রক্তবী' কাব্যগ্রন্থ। কবিতার পাশাপাশি সেতু প্রবন্ধ এবং ছোটগল্পও লিখে যাচ্ছে। রকিব আল হাফিজ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এখনও সততা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা আমার এক প্রিয়জন। চিন্তক প্রকৃতির লোক। মনে-মানসে প্রচন্ডভাবে আহমদ ছফার প্রভাব আছে। তখনও প্রবন্ধ লিখতো, এখনও প্রবন্ধ লিখে। কর্মজীবনে রাজস্ব বিভাগের ক্যাডার। সততার অপরাধে বারবার এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যেতে হচ্ছে, তবু সে আজও সততার পথে আপোষহীন। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার `রেনেসাঁর বিস্মৃত কাপ্তান'। গ্রন্থখানা মূলত বৃটিশ সময়ের মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ সি.আই.ই.এর জীবন-চরিত নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা। সাথী লাইব্রেরীতে আড্ডা জমে উঠার মূল কিংবা প্রধান কারণ শামীম শাহান। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে এখানের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো। লাইব্রেরীর মূল মালিক আব্দুল খালিক লেখক না হলেও আমাদের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো এবং আজও আছে। শামীম শাহানের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো হাসিমুখে কথা বলা এবং সবাইকে বন্ধু বলে সম্বোধন করা। সে তার এই মধুর চরিত্র দিয়ে বন্ধু মহলের সবার মন জয় করে নিতে তখনও পারতো, এখনও পারে। বর্তমানে সে লন্ডনে থাকলেও সাহিত্যের সঙ্গ ছাড়েনি। `গ্রন্থি' নামে একটি লিটেল ম্যাগ তার সম্পাদনায় প্রকাশ হয়, মাঝেমধ্যে। আমি না পাইলেও শোনেছি ‘ নীল দুপুর’ এবং ‘ নীল সাঁতার’ নামে তার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শাহ শামীম আহমদ আমার অন্যতম ঘণিষ্টজন। কবিতার সাথে তার ঘণিষ্ট সংসার হলেও রাজনীতিতে তার চোখ ছিলো প্রখর। বর্তমানে লন্ডনে আছে এবং কবিতাকে সাথে নিয়েই আছে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে বাড়ি ফিরে প্রকাশ করেছে `জলরঙ্গা দিন' কাব্যগ্রন্থ। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে আমি লন্ডন গেলে বন্ধুত্বের স্বাক্ষর বহন করে এক কপি আমার হাতে পৌঁছে। মতিউল ইসলাম মতিন ছড়াকার হিসাবেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত `জীবন মরণ যুদ্ধ আমার' তার প্রথম প্রকাশিত ছড়া গ্রন্থ। সিলেটে নব্বই দশকে যারা প্রবন্ধ সাহিত্যে শক্তি প্রদর্শন করেছেন তাদের অন্যতম আহমদ মিনহাজ। সে বর্তমানে প্রবন্ধের পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস নিয়েও কাজ করছে। ফকির ইলিয়াস আমাদের সবার বয়সে বড় হলেও আড্ডায় আসতেন বয়স্য হয়ে। আসলে তার সাহিত্যচর্চার শুরু বাউল গান দিয়ে। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার প্রথম গ্রন্থ `বাউল সঙ্গীত' থেকেই আমরা বুঝতে পারি তার যাত্রা। তবে পরবর্তীতে তিনি সাহিত্যের সবদিকেই কমবেশি হাটছেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ হয় তার `হৃদয়ে গাঁথা মালা' এবং `অনন্ত আত্মার গান'। তিনি বর্তমানে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে আছেন। আহমদ ময়েজ জগন্নাথপুরের এক ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যিক পরিবারের মানুষ। তার দাদা মরমি কবি পির মজির উদ্দিন, তার বাবা মরমি কবি পির মনফর উদ্দিন এবং তার বড় ভাই কবি ফরিদ আহমদ রেজা সাহিত্য জগতের পরিচিত একএকটি নাম। তবে ঐতিহ্যের পরিচয় ছাড়াও আহমদ ময়েজ এর নিজস্ব পরিচিতি ইতোমধ্যে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তিনি বয়সে আমাদের অগ্রজ, তবে আড্ডায় আজও বয়স্য। ছড়া দিয়ে না গান দিয়ে আহমদ ময়েজের সাহিত্যচর্চার শুরু তা হয়তো তার নিজের দ্বন্দ্ব আছে। গান হলো তার পারিবারিক ঐতিহ্য। তবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন ছড়া নিয়ে। বর্তমানে তিনি লন্ডনে আছেন এবং `ভূমিজ' নামে তার সম্পাদনায় বিশাল আকারের একটি লিটল ম্যাগ লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। ছড়া ছেড়ে আহমদ ময়েজ এখন হাটছেন কবিতা, গল্প, গান ইত্যাদি নিয়ে। আমাদের আড্ডার আসরে আসতেন সত্তর দশকের শক্তিমান কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। কিশওয়ার ভাই এখনও আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দুঃখ প্রকাশ করছি যে, আমি নব্বই দশক অতিক্রম করে তাঁর সম্পর্কে এখানে আলোচনায় যাবো না। সাথী লাইব্রেরীর আড্ডার বাইরেও নব্বই দশকের অনেক আছেন যাদের সাথে আমার অন্য কোথাও না কোথাও আড্ডা হয়েছে। পরবর্তীতে যদি সুযোগ পাই লিখবো তাদের নিয়েও। আর এই আড্ডার যদি কেউ বিস্মৃতির ধূলোর নীচে আটকে থাকেন, তবে দুঃখিত। সবার কথা বলার পর নিজের ঢোল নিজে বাজাইতে গিয়ে লজ্জবোধ করায় আমার নিজের কর্মের হিসাব পাঠকের হাতে ছেড়ে এখানেই ইতি টানলাম।
[ অক্টোবর, ২০০৯-এ মুক্তস্বর স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন