রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

ভাষা আন্দোলনের চেতনা

মা যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষায় সন্তান কথা বলবে, এটা মানুষের জন্মগত মানবিক অধিকার। এই অধিকার যারা বলপূর্বক ক্ষুন্ন করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামটাই মানবিক সংগ্রাম। আমাদের এই অধিকার ক্ষুন্ন করতে চেষ্টা করা হয়েছে ভারতবর্ষের আর্যযুগ থেকে পাকিস্তানের সময় পর্যন্ত। তবে পাকিস্তানীদের কর্মটা হয়ে গেছে বাকীদের থেকে জঘণ্য, তারা আমাদের উপর গুলি চালিয়েছে। বায়ান্নের একুশে ফেব্র“য়ারি ঢাকার রাজপথে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন আমাদের সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখরা। তাদের প্রাণদানটা ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে। তাই আমাদেরকে স্মরণ করতে হয় একুশের কথা, একুশের ব্যথা। একুশ মানে আমাদের হৃদয়-অস্তিত্ব নড়ে যাওয়া বিশেষ কিছু ঘটনা। বছর ঘুরে একুশ এলে আমরা নতুন করে অনুভব করি সেই পুরাতন ব্যথাগুলো হৃদয়ের পাঁজরে। একুশের দিনে রাজপথে ঝরা রক্তের উষ্ণতা দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পেরিয়ে আজো আমাদের চেতনায় স্পন্দন সৃষ্টি করে। আমরা সবাই নিজেদের মতো করে স্মরণ করি ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ স্মৃতি এবং ভাষা সৈনিকদের ত্যাগ। আজও যখন পাঠশালায় ছেলে-মেয়েরা চিৎকার দিয়ে বলে, `আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই' তখন আমার কানে ধ্বনিত হয় ভাষা সৈনিকদের মিছিল-শ্লোগান-আত্মচিৎকার-`উর্দু নয় বাংলা চাই। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চাই।' একুশ এমন একটি দিন, যা আমাদের ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রতীক। এই দিনে আমাদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিলো। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত করে বললেও খুব ছোট নয়। আমরা আজকের এই আলোচনা কোথায় থেকে শুরু করবো? আমাদের ভাষা আন্দোলনের পিছন কোথায়? আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কী? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদেরকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটুকু সম্মানিত করেছে?এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে অনেক ভিন্নমত আছে। জ্ঞানগর্ব-তাত্ত্বিক ভিন্নমতসমূহকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তবে যারা বলছেন, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, আর ভাষা আন্দোলনের সূচনা পাকিস্তান থেকে। তাদের সাথে আমাদের দ্বি-মত আছে। আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস শুরু করি বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে, তাহলে কি মীর কাসেম, হাজী শরিয়তুল্লাহ, তিতুমীর, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখেরা ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যান না? আর যদি শুরু করি ভাষা আন্দোলনের সূচনা পাকিস্তান দিয়ে, তা হলে আর্য-অনার্যের সংঘাত, সংস্কৃত-বাংলার সংঘাত, ইংরেজিÑবাংলার সংঘাত, হিন্দী-বাংলার সংঘাত, ফোর্ট উইলিয়ামী বাংলা আর আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সংঘাত ইত্যাদি কি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে না? আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, বাংলাভাষা কিংবা বাংগালী জাতীর ইতিহাস এতো সংক্ষিপ্ত নয়। এখানে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে আছে দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস' ঢ়ৎড়ঃড়-যরংঃড়ৎু. কিংবা আরো পিছনের দীর্ঘতম সময়ের ইতিহাস-ঢ়ৎব-যরংঃড়ৎু. আমরা আজকের আলোচনায় সেদিকে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই। আটারো শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে যে বাংলা চালুর চেষ্টা করা হয়েছিলো, তা এদেশের গণমানুষের মাতৃভাষা কোনদিন ছিলো না। ফলে তা আজ কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। এটা মূলত ছিলো ইংরেজীর অবয়বে সংস্কৃতি ভাষার কিছুটা পরিবর্তিত রূপ। ফোর্ট উইলিয়ামের ভাষা দেখে অনেকে বলে থাকেন বাংলা ভাষা সংস্কৃতি থেকে জন্ম নিয়েছে। এ কথাটাও সত্য নয়। সংস্কৃতি আর বাংলা যে এক জিনিস নয়, তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন আমাদের ভাষা পণ্ডিতরা।ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছেন, `বাংলা সংস্কৃতর দুহিতা নয়। তবে দূর সম্পর্কের আত্মিয়া।' (বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ)। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, বাংলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া শুধু সংস্কৃত নয়, ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাও। সংস্কৃত মূলত আর্যদের ভাষা। আর্যরা বাংলা অঞ্চলে এসেছেন বাংলা ভাষা জন্মের অনেক পর। আর্যরা প্রথম দিকে বাংলা বুঝতেন না বলেই এটাকে বলতেন অসুরের ভাষা। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম ইতিহাস `চর্যাপদ'। `চর্যাপদ' বৌদ্ধ যুগের সৃষ্টি। আর্য এবং তাদের পরবর্তী রূপান্তর ব্রাহ্মণদের হাতে বাংলা ভাষা বার বার আক্রান্ত হয়েছে। বাংলা অঞ্চল এবং বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত কিংবা আর্যদের পুরাতন কথা খুঁজলে এসবের সত্যতা প্রমাণীত হয়ে যাবে। আমরা যদি প্রাচীন আর্যদের কথাও ছেড়ে দেই এবং ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্ব-পর্যন্ত আর্যদের নব-সংস্করণ গুলো দেখি তবুও প্রকাশ্য কিংবা মৌন সংঘাত দেখতে পাই। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ব্রাহ্মণ্যবাদী মন কোনো দিন মেনে নিতে পারেনি বাংলার অস্তিত্ব। বৃটিশ শাসিত ভারতে প্রায় ১৭৯টি ভাষার অস্তিত্ব ছিলো। ভারতের স্বাধীনতালগ্নে প্রশ্ন উঠলো-ভারত স্বাধীন হলে রাষ্ট্রভাষা কী হবে? এ প্রশ্ন তখন অনেকের মাথায় ঘুরছিলো। ভারতের ১৭৯টি ভাষার তাত্ত্বিকদের কাছে ছিলো স্ব স্ব ভাষার পক্ষে যুক্তি। তারা এই যুক্তিগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করেন। বাংগালী পণ্ডিতরাও এগিয়ে আসলেন যুক্তি-তর্কের ময়দানে। বাংগালীদের অনেক শক্তিশালী যুক্তি থাকার পরও কিন্তু তারা নিজ ভাষার পক্ষে যুক্তিতে-আন্দোলনে ঐক্য হতে পারলেন না। তখন `এক ধর্ম, এক রাজ্য, এক সিংহাসনের' শ্লোগান দিয়ে ময়দানে এলেন ব্রাহ্মণ কেশব চন্দ্র। তিনি লিখলেন, `ভারতবাসীদিগের মধ্যে একতা লাভের উপায় কি?' তিনি নিজেই উত্তর দিলেন, `যতদিন সমস্ত ভারতবর্ষে এক ভাষা না হইবে ততদিন কিছুতেই একতা সম্পন্ন হইবে না। এখন যতগুলো ভাষা ভারতে প্রচলিত আছে তার মধ্যে হিন্দি ভাষা প্রায় সর্বত্র প্রচলিত। এই হিন্দী ভাষাকে যদি ভারতের একমাত্র ভাষা করা যায় তবে অনায়াসে শীঘ্র একতা সম্পন্ন হতে পারে। (সুলভ সমাচার, ৫ই চৈত্র ১২৮০ বাংলা, ১৮৭৪ ইংরেজি)।কেশব চন্দ্রের ভারতবাসীর মধ্যে একতা লাভের উপায়টা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু মানসেযৌক্তিক হলেও হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে অযৌক্তিক। কেশব চন্দ্রের পক্ষে- বিপক্ষে মতামত আছে। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রী রাজ নারায়ণ বসু কেশব চন্দ্রকে সমর্থন করে লিখেন, `ঞযব ড়ষফ ঐরহফঁ’ং ঐড়ঢ়ব' নামে একটি গ্রন্থ। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করা হয় ‘বৃদ্ধ হিন্দু আশা’ নামে। ভারতবর্ষ যখন প্রায় স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে তখনই করম মোহন চাঁদ গান্ধী প্রশ্ন উত্থাপন করেন `স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কি হবে?' আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বাংলা ভাষার এত বড় কবি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে হিন্দির পক্ষ নিয়ে গান্ধীর কাছে পত্র লিখেন-দঞযব ড়হষু ঢ়ড়ংংরনষব হধঃরড়হধষ নহমঁধমব ভড়ৎ রহঃবৎ ঢ়ৎড়ারহপরধষ রহঃবৎ পড়ঁৎংব রং ঐরহফর রহ ওহফরধ.' (রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা, ১৯৮৬ খ্রি., পৃ. ৭৮)।`একমাত্র হিন্দি ভাষা ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে' এমন কথা আমরা কমপক্ষে রবীন্দ্রনাথের মতো বাংগালী কবি'র কাছে আশা করিনি। এক্ষেত্রে কবি আমাদেরকে আশাহত করলেন। পণ্ডিত ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ কবি'র এ কথা মেনে নিতে পারেননি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সভায় তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে বাংলাকে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবী উত্থাপন করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে ঘোষণা করেন, `শুধু ভারতবর্ষে কেন সমগ্র এশিয়া উপমহাদেশে বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।' (ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ শতবর্ষ পূর্তি স্মারক, সম্পাদনায়-মোহাম্মদ আবু তালিব)।রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ নওয়াব আলী তৎকালিন বৃটিশ সরকারের কাছে লিখিত দাবী জানান, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলা।' (রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, সরকার শাহাব উদ্দিন, পৃ. ২৪৩)।আমরা ইতিহাসের আলোকে বলতে পারি বাংলা ভাষার উৎপত্তি যেমন সংস্কৃত থেকে নয়, তেমনি সংস্কৃতের ধারক-বাহক আর্যরা কোনোদিন বাংলার পৃষ্টপোষক কিংবা সমর্থক ছিলেন না। অপরদিকে মুসলমানরা যুগ-যুগে বাংলার পৃষ্টপোষকতা করেছেন, বাংলাকে ধারণ করেছেন, বাংলার জন্য লড়াই করেছেন, রক্ত দিয়ে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর্যদের রোষানল থেকে বাংলাকে প্রথম রক্ষার উদ্যোগী হলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। তাঁর শাসন ছিলো ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁর এই শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলাভাষা সরকারী পৃষ্টপোষকতা লাভ করে। ইলিয়াস শাহ যে বাংলাকে পৃষ্ট পোষকতা দিয়েছেন মূলত এটাই এই বাংলার সাধারণ মানুষের মাতৃভাষা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে ইংরেজ আর আর্যরা তা পাল্টিয়ে দিতে চেয়েছিলো। এ অঞ্চলের মানুষ তা গ্রহণ করেনি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্র“য়ারি রক্তাক্ত শরীরে বাংলা ভাষার যে বিজয় এসেছিলো এর মূল সূচনা প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের স্বাধিনতালগ্নের `হিন্দি বনাম বাংলা' বিতর্ক থেকে, যা ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। মূলত বাংলাভাষা এবং বাংলার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বাতন্ত্রতা ইত্যাদি নিয়েই পূর্ববঙ্গের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মানসিক এবং পরবর্তীকালে শারীরিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বাংলার মুসলিম নেতারা স্বপ্ন দেখতেন বিশাল স্বাধীন বাংলাদেশের। চল্লিশের লাহোর প্রস্তাবে এমন কথাই ছিলো। কলকাতার হিন্দু এবং কংগ্রেসের নেতারা তা মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘তিনি (অর্থাৎ শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী) একমাত্র ব্যক্তি যিনি খণ্ডিত পাকিস্তানে খণ্ডিত বাংলার কু’ফল উপলব্ধি করিতে পারিয়া ছিলেন। তাহার ফলে উদ্ভব হইয়া ছিলো বৃহত্তর বাংলার `সোহরাওয়ার্দী-বসু' চুক্তি। এই পরিকল্পনার প্রতি কায়দে আজমের আশীর্বাদ ছিলো। কিন্তু মি. বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে পরিচালিত চরমপন্থী কংগ্রেস মহল এবং মি. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর ন্যায় সাম্প্রদায়িকতাবাদীগণ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয় নাই।' (নেতাকে যেমন দেখেছি, শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, মার্চ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ)বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলী জিন্না কিংবা পাকিস্তানের উর্দুভাষী নেতারা প্রথম দিকে যে ছিলেন না, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়। ইতিহাসে এর আরো বহু প্রমাণ আছে। আমরা জানি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে `দৈনিক ইত্তেফাক' পত্রিকা। এই সময় দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, তিনিকে একাত্তরে পাক বাহিনী কিংবা তাদের দোসররা শহীদ করে দিয়েছিলো। সিরাজুদ্দীন হোসেন-এর বক্তব্য হলো-`দিল্লির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলো ১৯৪৬-এর ৯ এপ্রিল আর তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে দেশের সকল জাতীয়তাবাদী শক্তির সহযোগিতায় বাংলার হিন্দুদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাস ভূমি রচনার উদ্দেশ্যে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে ১৯৪৭-এর ৫ এপ্রিল ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই হিন্দু সম্মেলনে আরও যে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাতে বলা হয় `বঙ্গভঙ্গ' দাবীর সমর্থনে প্রচণ্ড প্রচার কার্য চালাবার জন্য (এই বছর) ৩০ শে জুনের মধ্যে একলাখ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ ও প্রতিটি জেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে স্থানীয় কমিটি গঠন করা হবে। সীমানা নির্ধারণের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে, সীমানা নির্ধারণ কমিশন নিয়োগের জন্য গণপরিষদের কাছে আবেদন করা হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বেই নতুন প্রদেশ সৃষ্টির জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার ও কেবিনেট মিশনের কাছে দাবী পেশ করা হবে। প্রয়োজনে নতুন প্রদেশভুক্ত হিন্দু পরিষদ সদস্যদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র আইন পরিষদ গঠন করা হবে এবং নতুন প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ব্যবস্থাদি পূর্বাহ্নেই সুসম্পন্ন করে রাখা হবে। সম্মেলনে হিন্দুদের প্রতি অবিলম্বে প্রত্যেক ইউনিয়নে `হিন্দুস্থান জাতীয় রক্ষী বাহিনী' বা `হিন্দুস্থান রাষ্ট্রীয় সেনা' নাম দিয়ে মিলিশিয়া গঠনেরও আহ্বান জানানো হয় এবং সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী সভাকে অপসারণ করে দু’টি আঞ্চলিক মন্ত্রীসভা গঠনের দাবী করা হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষে প্রেরিত এক বাণীতে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্রী ভি.আর.সাভারকার লিখেন-'অখণ্ড হিন্দুস্থানের ব্যবচ্ছেদ পরিকল্পনা বানচাল করতে হলে হিন্দুদের সর্বাগ্রে পাকিস্তান ব্যবচ্ছেদে উদ্যোগী হতে হবে। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গে একটি হিন্দু প্রদেশ পত্তন, দ্বিতীয়ত যে কোনো মূল্যে আসাম থেকে মুসলিম অনধিকার প্রবেশকারীদের বিতাড়ন করে দু'টি হিন্দু প্রদেশের মাঝে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানকে পিষে মারা এবং তৃতীয় পূর্ব পাঞ্জাবে একটি হিন্দু শিখ প্রদেশ প্রতিষ্ঠাই হবে এই পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ও প্রথম কাজ।' (সিরাজুদ্দিন হোসেন, ইতিহাস কথা কও, পৃ. ১১-১২)বঙ্গবন্ধুর নিবন্ধ থেকে আমরা যা পেয়েছিলাম তাই আমরা আরেকটু ব্যাপকভাবে পেলাম সিরাজুদ্দীন হোসেনের ‘ইতিহাস কথা কও' গ্রন্থে। সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা থেকে আমরা আরো জানতে পারি ভারতীয় হিন্দুরা ১৯৪৭-এর ৫ এপ্রিল অর্থাৎ পাকিস্তান জন্মের চারমাস পূর্বে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ এবং পূর্ব পাকিস্তানকে দু’হিন্দু প্রদেশের মাঝে ফেলে পিষে মারার। সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানইতো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। সিরাজুদ্দীন হোসেন পাকিস্তানের দালাল বা রাজাকার কিছুই ছিলেন না। এদেশের স্বাধীনতালগ্নে পাক বাহিনী আর রাজাকারদের যৌথ উদ্যোগে যে সব বু্দ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়, সিরাজুদ্দীন হোসেন ওদেরই একজন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যারা মাঝপথ থেকে শুরু করেন তাদের কথায় নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। সঠিক ইতিহাস বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে দীর্ঘ কিংবা দীর্ঘতম আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে।কোথায়, কখন, কিভাবে শুরু হয়েছিলো বাংলা ভাষা? সে হিসাব এখনো মিলাতে পারেননি গবেষকেরা। আলো-আঁধারী ভাষায় বৌদ্ধদের লিখা চর্যাপদকে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের উজানের সীমা। ভাষা জন্মের সাথে সাথেইতো আর সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তবে বাংলা ভাষার উম্মেষ, বিকাশ এবং পরিবর্তনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ না হলেও তের-চৌদ্দশ বছরের। কারা এ ভাষার উম্মেষ-বিকাশ ঘটিয়েছেন আর কারা অসুর-যবনের ভাষা বলে ঘৃণার সাথে বাংলাকে উপেক্ষা করেছেন? এই তের-চৌদ্দশ বছরের ইতিহাস ঘাটলেই বেরিয়ে আসবে সত্য কথাগুলো। এ প্রশ্নটির সঠিক উত্তর পেয়ে গেলেই আমাদের সামনে বেরিয়ে আসবে আমদের মাতৃভাষা আন্দোলনের চেতনা মূলত কোথায়? একটি রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পরও যারা কলকাতাকে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী বলেন কিংবা ভাবেন, হিন্দী প্রেমিক কলকাতার লেখক-সাহিত্যিককে নিজেদের থেকে বেশি গুরুত্ব দেন, তাদের অজ্ঞতার জন্য আমাদের করুণা হয়। বাংলা উচ্চারণ, বাংলা বানান এবং ব্যাকরণ যে ভাবে আমরা অর্থাৎ আমাদের পণ্ডিতরা করবেন তাই সঠিক। হিন্দির ছায়াতলে বসে যারা আজো বাংলা চর্চা করছেন আমরা সাধুবাদ জানাই তাদেরকে কিন্তু সাহিত্যের দিক নির্দেশক মানতে পারি না। আমরা জানি তেতুল গাছের নিচে বসে আমের আশা করা অনুচিৎ। এক ভাষার ভেতরে থেকে অন্য ভাষার চর্চা অন্যায় নয় কিন্তু সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন হয়না পরিবেশগত কারণে। কলকাতার সাধারণ মানুষ দিনে দিনে বাংলা থেকে বেশি হিন্দির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন, স্বাভাবিক কারণে। হিন্দি গ্রাস করে ফেলছে কলকাতার বাংলাকে। সেখানের বাংগালীরা বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য যেভাবে চেষ্টা করা প্রয়োজন ছিলো-সেভাবে করছেন বলে আমাদের মনে হয় না। মূলত তাদের চরিত্রটাই এ রকম যে, স্রোতের ভেতর সুবিধাভোগী হয়ে থাকা। বাংলা ভাষার উম্মেষ থেকে একুশে ফেব্র“য়ারি রক্তদান পর্যন্ত বেশির ভাগ কৃতিত্ব মুসলমানদের, একথা আজ স্বীকার করতেই হবে। কেশব চন্দ্র, রাজনারায়ণ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্যামা প্রসাদ প্রমুখের হিন্দি প্রেমের বিরুদ্ধে যদি ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলীরা কথা না বলতেন তা হলে হিন্দি প্রেমিক আর বাংলা প্রেমিকের মধ্যে সীমারেখা সৃষ্টি হতো কী দিয়ে? আমরা হয়তো এখনও তাদের খপ্পরে পড়ে থাকতাম হিন্দুস্তানের সাথে। আর যদি এমনটি হতো, তা হলে কোথায় থাকতো আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর কোথায় যেতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। হয়তো আমরা হতাম পশ্চিমবঙ্গের মতো বিলুপ্তীর পথযাত্রী বাংগালী, নতুবা কাশ্মীরীদের মতো স্বাধীনতাকামী লড়াকু গেরিলা।কলকাতার বুদ্ধিজীবী এবং কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা চিন্তা-চেতনার দিকে মোটেও স্বচ্ছ নয়। আর মানসিকতায় গোলামী রেখে দেশ ও জাতিকে মুক্তির পথ দেখানো যায় না। শুধু বাংলায় নয়, গোটা ভারতবর্ষে আমাদের হিন্দু নেতা ও পণ্ডিতরা বার বার এ কারণেই থেমে গেছেন। তারা নিজে কিছুই সৃষ্টি করতে পারেননি, কুকিলের মতো কাকের বাসায় ডিম দিতে তারা অভ্যস্ত। মুসলিম শাসনামলে তারা যেমন স্বক্রিয়তার কথা ভাবেননি তেমনি ভাবতে পারেননি ইংরেজদের শত জুলুমের সময়েও। আমরা যদি তাদের বাংলা চর্চার কথা ভাবি, তবে দেখতে পাই এখানে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ইংরেজ ফোর্ট উইলিয়ামের। আমরা যদি কংগ্রেসের কথা বলি, তা হলে এখানেও দেখতে পাই এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউস’ নামক ইংরেজের হাতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এ জন্ম। দীর্ঘদিন এই ইংরেজ সাহেব কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। ইংরেজ সভাপতির নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন হাস্যকর ব্যাপার। ব্যাপারটা এক সময় অনেকের দৃষ্টিতে লাগে। করম মোহন চাঁদ গান্ধীকে আফ্রিকা থেকে হায়ার করে এনে কংগ্রেসের লাগাম হাতে উঠিয়ে দেওয়া হলো। শ্রী গান্ধী বলদকে জিজ্ঞাস করে পাজুন চুকানোর নীতিতে কংগ্রেসকে পরিচালিত করতে লাগলেন। তাঁর অহিংস আর সহযোগ আন্দোলনে সুবিধাবাদী শ্রেণীর আশ্রয় হয়ে গেলো। এদিকে ইংরেজদেরও বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠে। গোটা ভারতবর্ষে মুসলমানের সংখ্যা কম নয়, ওদেরকে জড়াতে হবে কংগ্রেসের সাথে। এদিকে কমিউনিস্ট দর্শনের প্রভাবে হিন্দুদের কেউ কেউ অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে। সবকিছু সামনে নিয়ে মূল রশি হাতে রেখে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে। মাওলানা আজাদের নেতৃত্বে কংগ্রেস হয়ে গেলো ভারতের প্রধান বৃটিশ বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন। ভারত যখন স্বাধীন হতে যাচ্ছে কংগ্রেসের নেতৃত্বে, তখনই সমস্যা দেখা দিলো কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে। স্বাধীনতালগ্নে যিনি হবেন কংগ্রেস সভাপতি, তিনিই তো স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।মাওলানা আবুল কালাম আজাদ স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী; এটা যেমন হিন্দু মানস মেনে নিতে পারেনি, তেমনি ইংরেজরাও চায়নি। মাওলানা আজাদকে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব থেকে সরিয়ে নেহেরু কে নিয়ে আসা হলো। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় যিনি ছিলেন তিনি করম মোহন গান্ধী। মুসলমানদের মধ্যে যারা দিকভ্রান্ত হয়ে গান্ধীকে মহাত্মা বলেন, তাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। ইসলামের মৌলিক আকাইদের দিকেও আল্লাহ ছাড়া তার কোনো সৃষ্টিকে মহাত্মা বলা শিরক্।বঙ্কিম চন্দ্রকে বলা হয় বাংগালী হিন্দু সমাজের জাগরণের দূত। অথচ কর্মে-চিন্তায় বঙ্কিম বাবু ছিলেন সম্পূর্ণ ইংরেজ। জীবনে যা করেছেন সবই ইংরেজদের স্বার্থে। তাঁর হিন্দু জাগরণের প্রচেষ্টাটিও ছিলো ইংরেজ শাসনের ভীত আরো মজবুত করার লক্ষ্যে। তিনি হিন্দু জাগরণের প্রতিটি লাইনে লাইনে কটুক্তি করেছেন মুসলমানদের প্রতি। তাঁর মূল উদ্দেশ্যই হয়তো ছিলো সা¤প্রদায়িক সংঘাত। আমাদের বুঝা উচিৎ ইংরেজ শাসনের মূলনীতি ছিলো-ডিভাইড এন্ড রুল। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভেতর অনৈক্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইচ্ছে মতো শাসন চালিয়ে যাওয়া। মাইকেল মধূসূদন দত্ত ইংরেজ হওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বৃটেন গিয়েছিলেন। ইংরেজরা জাতীয়তাবাদে খুব কট্টর। মাইকেল বাবু ইংরেজ হতে পারেননি। ব্যর্থতার বেদনা নিয়ে ফিরে এসেছেন স্বজাতীর ভেতর। বাংগালী হওয়ার পীড়া রবীন্দ্রনাথের ভেতরেও হয়তো ছিলো। নতুবা তাঁর কলম দিয়ে কেন বেরুবে- `রেখেছো বাংগালী করে/মানুষ করনি।'আমাদের যারা বাংগালী বলতে হিন্দু বুঝেন কিংবা হিন্দু বলতে বাংগালী বুঝেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-সেই অবিভক্ত বাংলার বিধান সভায় নব-নির্বাচিত মুসলিম সদস্যরাই ছিলো খাঁটি বাংগালী। এর আগে রাজনীতিতে আসতেন শুধু জমিদার, উকিল, ব্যারিস্টার, রায় বাহাদুর কিংবা খান বাহাদুর। তাদের পোশাক হয় সাহেবী অথবা চেগে চাপকান। মুখের ভাষা সব সময়ই ইংরেজি। কিন্তু গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্বাচিত মুসলিম প্রতিনিধিরা বিধান পরিষদে নিয়ে এলেন বাংলাভাষা। লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবী পরে আসতেও তাদের দ্বিধা নেই। পশ্চিম বাংলার দিকের মুসলমানেরাতো ধূতিও পরেন নিয়মিত। তাঁরা তাদের বক্তব্য বাংলাভাষায় পেশ করতে লাগলেন। তখন নিয়ম ছিলো কোনো সদস্য বাংলায় বক্তৃতা করলে তা রেকর্ড করা হতো না। বক্তব্যের সারাংশ ইংরেজিতে তর্জমা করে দিতে হতো। তবু তারা বাংলায় বলতেন। বাংগালী হিন্দু নেতারা ততদিনে খদ্দরের ধূতি-পাঞ্জাবী ধরেছেন বটে, কিন্তু বক্তৃতার সময় ইংরেজির ফোয়ারা ছোটান। কে কী বলেন সেটা বড় কথা নয়, কে কত জোরালো ইংরেজির তুবড়ি ছোটাতে পারেন, সেটাই যেন গর্বের বিষয়। হিন্দু নেতাদের মধ্যে এ রকম একটা হীনমন্যতা ছিলো যে, লোকটা ইংরেজি জানে না। শিক্ষিত মুসলমানদেরও বলাই নেই। যারা ইংরেজিতে ভালো বক্তা তারাও ইংরেজি ছেড়ে প্রায়ই শুরু করতেন বাংলায়। স্বয়ং ফজলুল হক (শেরে বাংলা) ছিলেন শিক্ষা-দিক্ষায় অনেকের চেয়ে উঁচুতে, তিনি মাঝে মাঝেই ইংরেজির বদলে শুধু বাংলায় নয়, একেবারে খাঁটি বরিশালি বাংলায় কথা বলতেও দ্বিধা করতেন না।' (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৯৭)।ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেছিলেন , `শুধু ভারতবর্ষে কেন সমগ্র এশিয়া-উপমহাদেশে বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।' দীর্ঘদিন পর ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লার কথা কিছুটা হলেও বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমূখদের প্রাণ বিসর্জনকে স্মরণ করে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারী এশিয়ার সীমা ডিঙ্গিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটা যদিও বাংলাদেশ কিংবা বাংলা ভাষাকে এখনও তেমন কোনো সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত করেনি, কিন্তু এই স্বীকৃতিটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই স্বীকৃতিটা বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনের একটা সিঁড়ি তৈরী করে দিতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে আমরা যদি বাংগালীরা তা চাই। আমরা যদি বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করি, তবে পৃথিবীর অন্য কেউ আমাদের জন্য এগিয়ে আসবে না। বাংলা ভাষাকে, বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে সম্মানজনক আসনে নিয়ে যেতে হলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের নাগরিকদের ভেতর দেশপ্রেম-মাতৃভাষার প্রেম জাগ্রত করে আন্তর্জাতিকমানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, ব্যাঙের ছাতার মতো ইংলিশ স্কুল আর ইংরেজী বলতে পারার নামই আন্তর্জাতিক মান নয়। ভাষা হিসাবে ইংরেজী কিংবা অন্য কোন ভাষা শিখা অপরাধ নয়, কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে অন্য কোন বিদেশী ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া অবশ্যই জঘন্য মানসিকতার পরিচয়। বিদেশ যাওয়া কিংবা অন্য কোন লোভে যারা বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ইংলিশের পিছনে ঘুরছেন, তারা মূলত নিজের আত্মপরিচয়কে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তাদের জন্য খুব দুঃখ হয়, দুঃখ হয় নিজের দেশটির জন্য। এই আলোচনার শেষ প্রান্তে সম্মানিত পাঠকদের প্রতি একটা কাকুতি রেখে যাবো যে, জাতি-পরিবার এবং নিজের আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বার্থে পরমুখিতা পরিহার করে স্ব-স্ব মনে আবার দেশীয় আত্মপরিচয়ের অহম জাগাতে হবে। অতঃপর সকলের দায়িত্ব আজকের আধিপত্যবাদীদের এই মুক্তবাজার বিশ্বায়নের সময়ে আমাদের ভাষা আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে দেশপ্রেমের চেতনাকে ধারণ করে দেশ-জাতিকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাঠে মোকাবেলার যোগ্যতাসম্পন্ন করে দাঁড় করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন