রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

বৈশাখের চেতনা কিংবা আমাদের বাঙ্গালিত্ব

নববর্ষ প্রতি বছর আসে বাংলা, ইংলিশ, আরবি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যালেন্ডার হিসেবে। আমরা সম্পর্কের যোগসূত্রে পালন করি এই নববর্ষগুলো। তবে বাংলা নববর্ষ আমাদের একান্ত নিজস্ব। মুসলমানদের কাছে ধর্মগত কারনে আরবি ক্যালেন্ডারের গুরুত্ব অনেক। যেহেতু এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠি মুসলিম, তাই এখানে বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে আরবি ক্যালেন্ডারের আত্মার আত্মীয়তা দেখতে পাওয়া যায়। এই দুয়ের উদ্ভাবক, প্রবর্তক মূলত মুসলমান। হিজরী ক্যালেন্ডারের শুরু আরব থেকে। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মদীনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হযরত ওমর (রা.)-র খিলাফতের সময় আরবি ক্যালেন্ডারের সূচনা। এর পূর্ব পর্যন্ত আরবে হস্তি সন চালু ছিলো। হস্তি সনের সূচনা মহানবী (সা.) এর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে ইয়ামনের বাদশা আবরাহার কা’বা ঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে হাতি অভিযানকে কেন্দ্র করে। হযরত ওমর (রা.) খলিফা হওয়ার পর চিন্তা করলেন মুসলমানদের নিজস্ব একটি ক্যালেন্ডার প্রয়োজন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন। হযরত ওমর (রা.) এই বছরের ১৬ জুলাইকে ১লা মহরম হিসাব করে হিজরী ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন। ভারতবর্ষে হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয় ৭১২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৮০ হিজরীতে। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৫৭৯ হিজরীর দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে হিজরী সনের প্রবর্তন হয়। হিজরী ৯৬৩ সনে মোঘল সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের সিংহাসনের অধিকারী হলেন। তাঁর মতারোহনের দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলায় হিজরী সন রাজস্ব আদায়ের েেত্র প্রযোজ্য ছিলো। বিশ্বের একমাত্র ছয় ঋতুরদেশ বাংলাদেশে চাঁদের তারতম্যের কারণে চন্দ্র মাসের হিসাবে খাজনা আদায়ের দিন নির্দিষ্ট করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলার জনগণ সম্রাটের নিকট এই অসুবিধার কথা উপস্থাপন করলে সম্রাট এই সমস্যা নিয়ে নবরত্ন সভায় আলোচনায় বসলেন। সেই সভার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য আবুল ফজল এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব রাজ্যের বিশিষ্ট্য জ্যোতিষ বিজ্ঞানী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দেয়ার পরমর্শ দিলেন। শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে সম্রাট তাই করলেন। পন্ডিত সিরাজী প্রচুর গবেষনা করে একটি সন উদ্ভাবন করেন। যা নামকরন হয় এলাহী সন, ফসলী সন এবং বাংলা সন নামে। বাংলা সনের উৎপত্তি মূলত হিজরী সন থেকে। সম্রাট আকবর অতপর বাংলা অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ে বাংলা সন ব্যবহার করতে শুরু করেন। ইংরেজ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের সরকারী ক্যালেন্ডার বাংলায় চালু ছিলো। ইংরেজরা পলাশীতে শুধু বাংলার শাসন মতা ছিনিয়ে নেয়নি বরং সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়েছে বাংলার মুসলমানদের অস্তিত্ব ধ্বংস করে দিতে। ইংরেজদের আনুকূল্যে বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদির চাবি কাঠি চলে যায় বর্ণবাদি হিন্দুদের হাতে। এরপর শুরু হয় সর্বপ্রকার অত্যাচারের সাথে সাথে ইতিহাস বিকৃতি। দীর্ঘ দু’শ বছরের পরাধীনতার ফলে বাংলার মুসলমানরা আস্তে আস্তে সব কিছু হারাতে লাগলো। এই অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের স্বাধিনতার পাশাপাশি বিভক্তির মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের জন্ম। পাকিস্তানের শাসকেরা উর্দু জাতীয়তাবাদের নামে পাঞ্জাবী শাসন শুরু করলে এক পর্যায়ে শুরু হলো সংঘাত। সংঘাতে তারা ইসলামকে করে নিলো হাতিয়ার। অবশেষে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নয় মাস যুদ্ধের বিনিময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশের সম্মান পেলেও শিক্ষাদীক্ষায়, অর্থনীতিতে আজও এই দেশ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারেনি। বৃটিশদের তৈরী শিক্ষার প্রভাবে আজও দেখা যায় আমাদের শিতিদের মস্তিষ্কে চাকুরী-নকরী-আমলা-কামলা হওয়া কিংবা বিদেশ যাওয়া ছাড়া স্বচ্ছ স্বদেশী চিন্তা তেমন একটা নেই। ফলে আমাদের প্রায় সকল ক্ষেত্রে আজ স্বদেশী চিন্তা থেকে বেশি বিদেশ মুখিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নোংরা রাজনীতির খেলা চলছে বিদেশীদের চোখের ইশারায়। এই খেলায় জাতির বিবেক বলে খ্যাত বুদ্ধিজীবীদের পর্যন্ত বুদ্ধিলুপ্ত হয়ে আছে। বিশেষ করে ইতিহাসের বিকৃতিটা খুবই লজ্জাজনক। ফলে আমরা জাতীয়ভাবে নিজেদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলছি দিন-দিনে। আজকের আলোচনায় আমরা সেদিকে দৃষ্টিপাতের চেষ্টা করবো। আমরা যদি এই সকল বিকৃতি থেকে আগামী প্রজন্মকে রা করতে পারি তবেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।প্রসঙ্গ: জাতীয়তাবাদএকাত্তরের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের সংঘাত শুরু হয়। এখানে একদল বলছেন, বাংগালী জাতীয়বাদের কথা। অন্যদল, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে জাতীয় সংসদে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিল উত্তোলন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এমপি মানবেন্দ্র নারায়ন সন্তু লারমা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আমি বাংগালী নই বরং চাকমা, তবে বাংলাদেশী নাগরিক। তখন সরকারী দলের এমপি তসলিমা আবেদ বলেছিলেন, আপনি চাকমা হলেও বাংগালী। একথা আপনাকে মেনে নিতেই হবে। প্রতুত্তরে সন্তু লারমা বলেছিলেন, হতেই পারে না। আমি বাংগালী নই, তবে বাংলাদেশের নাগরিক। (দৈনিক ইত্তেফাক ২৪/১/১৯৭৪খ্রিস্টাব্দ)।আওয়ামীলীগ তখন মতায়। সেই সংসদ ছিলো বিরোধী দলহীন। ফলে বিলটি পাস হয়ে যায়। কিন্তু এর প্রতিবাদে সন্তু লারমা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে দেশে মতার পরিবর্তন ঘটে। মেজর জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে মতায় আসেন। এসেই তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে বিরাট সংশোধনী আনেন। এই সময় তিনি বাংগালী জাতীয়তাবাদ বাতিল করে বাংলাদেশী জাতীয়তবাদের সংবিধান ঘোষণা করেন। আওয়ামী রাজনীতির বিশ্বাসীরা মেজর জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সাথে সেদিনও একমত হননি, আজও হচ্ছেন না। এখানে দুটা গ্রুপের আস্তিত্ব এসে গেলো। আমরা এই বিষয়টির সমাধান এভাবে করতে পারি-ধর্মীয় দিকে আমরা মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান যে যাই হই, ভাষাগত দিকে সবাই বাংগালী আর রাষ্ট্রীয় দিকে বাংলাদেশী। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের স্বার্থে আমাদেরকে এই সমাধানে আসতে হবে। বাংলা ভাষা ও বাংগালীর ইতিহাসআমরা বাংলা ভাষা বা বাংগালী জাতির ইতিহাস পাঠে মাঝেমধ্যে বিষ্মিত হই আমাদের অনেক লেখক গবেষকের ইতিহাস বিকৃতির পথ ও পদ্ধতি দেখে। প্রসঙ্গক্রমে আমরা এখানে বলতে চাই আমাদের কেউ কেউ মনে করেন বাংলা ভাষার উৎপত্তি ‘সংস্কৃত’ থেকে। কেউ আবার ৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ষ্টপিজ দিয়ে এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয় বাংলা ভাষা এখান থেকেই শুরু। কেউ আবার ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে পাকিস্তানের সাথে মুসলমানিত্বকে মিশিয়ে ইসলামের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার কাজে ব্যস্ত হয়ে মূল কথা হারিয়ে ফেলেন। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃতের সম্পর্ক মা কিংবা বাবা-ছেলের নয়। সম্পর্কটা হলো সৎ ভাই কিংবা পাশের বাড়ির চাচার মতো। আজ পর্যন্ত বাংলা লিখিত সাহিত্যের যে আদি পাওয়া যায় তা হলো-চর্যাপদ। এই চর্যাপদ সহজিয়া আলো-আধাঁরি ভাষায় বাংলার বৌদ্ধদের কর্তৃক রচিত। বাংলায় এক সময় বৌদ্ধদের শাসন ছিলো। মধ্য এশিয়ার বিতাড়িত যাযাবর দস্যু আর্যরা এসে জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে ভারত অঞ্চলে তাদের বসতি শুরু করে। ওরাই আধুনিক সময়ে এসে হিন্দু হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তবে এখানে স্মরণ রাখতে হবে, হিন্দু মানেই আর্য নয়। প্রকৃত অর্থে হিন্দু নদীর তীরে কিংবা হিমালয়ের পাদদেশের বাসিন্দা অর্থে প্রথম দিকে এই অঞ্চলের সবাইকে হিন্দু হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছিলো। আর্যরা ভারত অঞ্চলে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের সকল সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে গ্রাস করে নিজেদের কেন্দ্রিক করে নিলে বাকীদের পরিচিতি হারিয়ে যায়। আর্যরা সর্বদাই অনার্যদেরকে ইতর প্রাণী মনে করতো।(এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি-‘দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি’ গ্রন্থে)। যেহেতু বৌদ্ধরা ছিলো অনার্য তাই তারা বৌদ্ধদেরকে ভাবতো ইতর। বৌদ্ধরা বাংলা ভাষায় কথা বলতো বলে আর্যরা বাংলাকে ইতরের ভাষা হিসেবে ঘৃনা করতো। এক সময় বৌদ্ধদের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় বাংলা থেকে। হিন্দু রাজাদের অত্যাচারে আকাশ বাতাস কম্পিত হয়ে উঠে। বাংলার সাধারণ মানুষের আহবানে ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি আর্য হিন্দু রাজা লন সেনের হাত থেকে বাংলাকে স্বাধীন করেন। এরপর মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলাভাষা আবার কদর পেলো। যার বাস্তব প্রমান সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা সনের প্রবর্তন। বাংলা বলতে তৎকালীন সময় আজকের বাংলাদেশকে শুধু বুঝাতো। পশ্চিম বাংলা এই বাংলায় ছিলো না। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পরবর্তীতে লনাবতী রাঢ় ইত্যাদি অঞ্চলকে বাংলার সাথে যুক্ত করেন এবং নিজে শাহ-ই-বাঙাল’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙালা’ উপাধি ধারন করেন। এরপর লনাবতী ও রাঢ় লোকেরা বাংগালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ড. দিনেশ চন্দ্র সেনের ভাষায় সেখানে (সংস্কৃত ওয়ালাদের কাছে) বঙ্গ ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পন্ডিত মন্ডলী দূর-দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি ডোরের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মনেরা যে রূপ দুর থাকেন, তেমনি ঘৃনা অনাদর ও উপোর পাত্র ছিলো। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের পতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরুপ ডুবুরীর অপক্ষা করে তেমনি যেনো বাংলা ভাষা দীর্ঘদিন সুলতান শামসুদ্দিন শাহের অপোয় ছিলো। বাঙালার সাথে যে কিছু অংশ যোগ দিয়ে বিশাল বাংলা গড়ে তুলেছিলেন সেই অংশগুলো আবার বাংলা থেকে পৃথক হয়ে যায়। পশ্চিম বাংলার কলকাতা কিংবা পশ্চিম বাংলাকে প্রকৃত বাংগালী বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়। কিন্তু ভূ-গোলিক ইতিহাস স্বাক্ষী আজকের পশ্চিমবঙ্গেকে বাংলার সাথে যুক্ত করে বাংগালী করেছিলেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। পশ্চিম বাংলার লোকেরা মূলত রাঢ় অঞ্চলের লোক। ওদরে সাথে আমাদের বাংলার পার্থক্য আদি থেকে। এই পার্থক্য আজও আছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম নির্বিশেষে। ড. দিনেশ চন্দ্র সেন আরো বলেন, বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপোয় বঙ্গীয় চাষার গানের কথষ্ণিৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পন্ডিতেরা নস্যাধান হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া সিনা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং ‘তৈলাধারা পত্র’ কিংবা ‘প্রাতধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাছাড়া হর্ষ চরিত হত্রিত ‘হারাং দেহি যে হরিনী’ প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিস্কার করিয়া আত্মপ্রসাধ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরী, দত্ত কুমার চরিত্র প্রভৃতি গদ্যে অপূর্ব সমাজবদ্ধ পদের গৌরভ আত্মহারা হইয়াছিলেন। (বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব-দীনেশ চন্দ্র সেন)। এখন আশা করি যে প্রাজ্ঞজনেরা মনে করতেন বাংলা এসেছে সংস্কৃত থেকে তারা কিছুটা বুঝতে সম হয়েছেন বাংলা ভাষা যে সংস্কৃত থেকে আসেনি। তবে প্রশ্ন হতে পারে-বাংলা ভাষায় সংস্কৃত এর প্রভাব এলো কিভাবে? বাংলা ভাষায় সংস্কৃত এর প্রভাব এসেছে মূলত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে পর। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন মোতাবেক ১১৬৪ বাংলার ৯ আষাঢ় পলাশীর ময়দানে বাংলার স্বাধীনতার বিপর্যয় ঘটে। এরপর শুরু হয় মুসলমানদের উপর বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন। এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলমানরা সোচ্চার থাকায় ইংরেজরা শান্তিপূর্ণভাবে কোন কাজে কৃতকার্য হতে পারছিলো না। তাই তারা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল অবলম্বন করতে লাগে। এরই অংশ হিসেবে তারা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, ১৮০০ খ্্িরস্টাব্দে। বিজ্ঞ মহলের মতে ইংরেজদের সহযোগী হিসাবে হিন্দুরা বিভিন্ন প্রকার সরকারী সুযোগ সুবিধা মুসলমানদের থেকে বেশি পেয়েছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেও হিন্দুদের কর্তৃত্ব ছিলো। এই সুযোগে তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সংস্কৃতের প্রভাব বিস্তারে কিছুটা সফল হয়। বিজ্ঞ ভাষাজ্ঞানীদের মতে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ডুকানোর ফলে তা এক সময় কঠিন দুর্বোধ্য ভাষায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লার মতে, যদি পলাশীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত তবে হয়তো এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলমানদের পুস্তকের ভাষা হইত। (শহীদুল্লাহ সম্বর্ধনা গ্রন্থ ৪২১)।বাংলা ভাষাকে ভারতবর্ষের জাতীয় ভাষার মর্যাদা দানের দাবী উত্থাপন করেছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী, মাওলানা আকরম খাঁ, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লা প্রমুখ। কিন্তু দুঃখজনক এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বাংলার পে কথা না বলে বরং উল্টো গান্ধজীর কাছে চিঠি দিয়ে জাতীয় ভাষার জন্য হিন্দির পে কথা বলেন। (রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, প্রভাব মুখোপধ্যায়)। তাছাড়া বিশ্বভারতীতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লা বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার পে যুক্তি উপস্থাপন করেন। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বক্তব্যে হিন্দীকে জাতীয় ভাষা করার পে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। (অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুম, দৈনিক ইনকিলাব ১/১/১৪০১ বাংলা)।১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতালগ্নে ভারতবর্ষ বিভিন্ন কারণে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বাংলা ও আসামের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়। এগারো শ মাইলের ব্যবধানে বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করাকে আমরা বলতে পারি নেতাদের হটকারী সিদ্ধান্ত। অনেকের ধারণা শুধু ধর্মীয় কারনে বাংলা গিয়েছিলো পাকিস্তানের সাথে, কথাটা এমন করে সত্য নয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে শুধু ধর্মীয় কারনে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়নি। এখানে প্রধান কারণ ছিলো সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভাষা, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি দিকে হিন্দু কংগ্রেসিদের বৈষম্য নীতি। বাংলার মুসলমানেরা ভেবেছিলেন, যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানীরাও মুসলমান তাই হয়তো তারা বৈষম্য দেখাবে না। কিন্তু পাকিস্তানের নেতৃত্ব তাদের কর্মনীতির মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের ধারনাকে মিথ্যা প্রমানিত করে দিলেন। ফলে পাকিস্তান জন্মের পরই শুরু হয়ে যায় ভাষা নিয়ে সংঘাত। বাংলাভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দানের যে আন্দোলন সৈয়দ আমীর আলী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা প্রমুখরা শুরু করেছিলেন তামাদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে, তা আবার নতুন প্রেরণায় নতুন প্রজন্মদের মাথায় ঘুর্ণন দিয়ে উঠে পাকিস্তানের জন্মের পর মুহাম্মদ আলী জিন্নার এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা এবং পরবর্তীতে রক্ত ও প্রানদান বাংলা ভাষার জন্য কত বড় অবদান? তা বিষ্মিত হয়ে আমাদের ভাবতে হয়। আমরা এই বাংলার মানুষ আজ ভাষার দিকে বাংগালী আর রাষ্ট্রীয় দিকে বাংলাদেশী। অন্যদিকে ভারতীয় বাংগালীরা আজও হিন্দির গোলামীতে আবদ্ধ। ওদের স্বতন্ত্র কোন পরিচিতিও নেই। ওদের ভাষা কিংবা রাষ্ট্রীয় জাতীয়বাদের পরিচিতি ভারতীয় হিসাবে। ওরা বাংলা ভাষায় কথা বললেও এই নামে তাদের জাতীয়তাবাদের পরিচিতি দেয়া যায় না। ইংরেজ বলতে বুঝায় ইংল্যান্ডের আদি আধিবাসীদেরকে, কিন্তু আমেরিকানদের কে তা বুঝায় না,যদিও তারা ইংরেজিতে কথা বলে। তেমনি রাঢ় অধিবাসীরা বাংলা ভাষায় কথা বললেও মূলত বাংগালী নয়। প্রত্যেক জিনিষ তার মুলের দিকে প্রত্যাবর্তন করে বলেই আজকের পশ্চিম বাংলা বলে পরিচিত রাঢ় অঞ্চল প্রকৃত বাংলা অর্থাৎ স্বাধীন বাংলার সাথে আসছে না। হয়তো আসবেও না।হালখাতা বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে বাংলার ব্যবসায়ীরা এক সময় পুরাতন বছরের হিসাব নিকাশ করতেন, যাদের কাছে ঋণ আছে তাদেরকে মিষ্টি বিতরনের মাধ্যমে পরিশোধের আহবান জানাতেন। ব্যবসায়ীরা সারা বছরের লেনদেন যে খাতায় লিখে রাখেন তাই ‘হালখাতা’। এক সময় প্রচলন ছিলো হালখাতা মানে ভেতর সাদা এবং ওপরের মলাট শক্ত কাগজে লাল মোড়কে বাঁধা। বৈশাখিকে কেন্দ্র করে যে হালখাতার বাকী উঠানোর নিয়ম, তা কবে, কে শুরু করেছেন তা নিয়ে অনেককে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়। অনেকে বলে থাকেন, যেহেতু এই দিন হিন্দুরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের দেবতা গনেশের (হাতির) পূজা করে তাই হয়তো হালখাতার সূচনা সংস্কৃত থেকে। এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু বাংলা সনের উদ্ভাবনই করা হয়েছে সম্রাট আকবরের নিদের্শে রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে। রাজস্ব আদায় অর্থই তো হিসাব নিকাশ করে সরকারী টেক্স দান। তাই হালখাতার সূচনা সংস্কৃত থেকে নয়, বরং সম্রাট আকবর থেকে। দীর্ঘ পথ চলে এই হালখাতা এক সময় বাংগালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে গিয়েছিলো। আজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আর ইংলিশ ক্যালেন্ডারের প্রভাবে আমাদের মধ্য থেকে এই ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। সরকার ইচ্ছে করলে আমাদের খাজনার হিসাব বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে মিলিয়ে করে নিতে পারতেন এবং তা করলে হালখাতার ঐতিহ্য আর বিলুপ্তির পথযাত্রী হতো না এবং বাংলা ক্যালেন্ডারের গুরুত্ব বৃদ্ধি লাভ করতো।নববর্ষ উদযাপন১লা বৈশাখ নববর্ষ, আমাদের বাংগালীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি নববর্ষ উদযাপন করলেও খুব কম জাতির নিজস্ব ক্যালেন্ডার রয়েছে। এদিক দিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি-আমাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডারের জন্য। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে বাংলা সন কিংবা নববর্ষের সাথে হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত কোন সম্পর্ক নেই। তবে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার কারনে ইতিহাসের বল তাদের মাঠে খেলা করছে।

২টি মন্তব্য:

  1. শাইখ,"আপনার লাহোর থেকে কান্দাহার" পড়েছি।খুব শিহরিত হয়েছি এবং এখনও হই।সত্যিই কি আমরা খিলাফাতের একটা ভালো সুযোগ হারালাম।আমরা কেন তার হাতে বায়াত হলামনা?

    উত্তরমুছুন
  2. সালাম।শাইখ, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ, ইমাম ইবনুল কায়িম,ঈমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ,শাহ ঈসমাইল শহিদ রহিমাহুমুল্লাহর কী কী কিতাব অনুবাদ হয়েছে এবং কোন কোন প্রকাশনী থেকে ? যদি জানাতেন তবে কৃতজ্ঞ হতাম!

    উত্তরমুছুন