রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

ওয়াম্যান ( মঞ্চনাটক )

প্রথম দৃশ্য
ষোল বছরের যুবক মাটিন, তার শরীরে হাফ টি শার্ট, টি শার্টের বুকে বিদেশী নায়ক কিংবা নায়িকার ছবি, হাটু পর্যন্ত কাটা জিন্সের পেন্ট পড়নে। তার ঘরের ভেতর মাইক্যাল জেকসনের পপ সংগীত হাই শব্দে বাজছে সিডি প্লেয়ারে। গানের তালে তালে সে নাচতেছে এবং শব্দ করে বলছে, `ওয়া ম্যান `ওয়া ম্যান' ওয়া, ওয়া ম্যান' ওয়া ম্যান, ওয়া...এই সময় ছেলের বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরেন। ছেলের রোমে ডুকতে গিয়েও ডুকেননা। তিনি নিজের রোমে ফিরে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে কানে হাত দিয়ে ছেলের ওয়া ম্যান, ওয়া ম্যান শব্দ থেকে নিজের শ্রবণ শক্তিকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন এবং বার বার বলতে থাকেন `খাল কেটে কুমির এনেছি ঘরে'। শেষ পর্যন্ত আমও যাবে, ছালাও যাবে দেখছি।

দ্বিতীয় দৃশ্য
মাটিন `ওয়া ম্যান, ওয়া ম্যান' এর সাথে নৃত্য করছে। ছেলের মা আসেন স্কুল থেকে। মা প্রথমে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে হাতের খাতা-পত্র রেখে স্বামীকে খুব চিন্তিত দেখে জানতে চাইলেন,`তোমার কি হয়েছে, শরীর খারাপ নাকি?মাটিনের বাবা একটু চোখ উঠিয়ে দেখেন ছেলের মাকে এবং সাথে সাথে বলেন,`শরীর খারাপ নয়, মাথা খারাপ। দেখ সোনামনি ইংলিশ ম্যানের হালচাল?ছেলের মা তখন একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলেন,`আমি তোমাকে বার বার বলেছিলাম তাকে দেশীও স্কুলে দিতে। দেশি শিক্ষা ছাড়া দেশি সংস্কৃতি শিখাবে কি ভাবে? তোমার একটা ভুল ধারণা যে, আমাদের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো নয়, আর দেশীয় প্রতিষ্ঠানে পড়লে কোন কাজে লাগবে না। আচ্ছা বলো দেখি, আমাদের সময় ব্যঙের ছাতার মতো এতো কেজি আর ইংলিশ স্কুল ছিলো কি? তুমি-আমি কি কোনো কাজে লাগিনি? তুমিতো লন্ডন-আমেরিকার শিক্ষা পদ্ধতি দেখেছো, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, সুযোগ-সুবিধা ভালো, কিন্তু এই তুলনায় শিক্ষা ব্যবস্থা কিন্তু খুব উন্নত বলা যাবে না। অবশ্য গ্রামার স্কুলগুলোর অবস্থা ভিন্ন। তারা গ্রামার স্কুলের পিছনে যে টাকা খরচ করে তা আমরা যদি করতে পারতাম তবে তারা কোনদিন আমাদের থেকে অগ্রসর হতে পারতো না। আমি কত বললাম, তাকে ইংলিশ মিডিয়ামে না দিয়ে প্রাইভেট স্কুলে দিতে। তুমি তাকে দিলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তুমি বললে, সে ভালো ইংলিশ শিখতে পারলে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাবে। আর যদি সুযোগ পায় তবে বড় কিছু হবে। আর সেই সময় আমাদের দিন ফিরে যাবে। এখন সে যে হাল ধরেছে মনে হচ্ছে দিন ফিরবে সুখের নয়, দুঃখের।মায়ের মুখে ছেলে সম্পর্কে আশাহীন কথা শোনে বাপের চোখে জল আসে, তিনি চোখ মুচতে মুচতে স্ত্রীর হাত ধরে বলেন,-রাহেলা, আমি নিজেই নিজের ঘরে খাল কেটে কুমির এনেছি। নিজে লন্ডন পড়ার সময় দেখলাম কতো ভালো মানুষের ছেলে মেয়েরা দেশ থেকে স্কলারশীপ নিয়ে লেখা পড়া করতে গিয়ে হারিয়েছে নিজের আত্মপরিচয়। তবু আমার শিক্ষা অইলো না। নিজেই খাল কেটে কুমির আনলাম নিজর ঘরে। এখন কিতা করতাম তুমি কও? এখনতো সে বড় হয়েগেছে। আর চাইলেও যে পারবো না নতুন করে বাংলা মিডিয়ামে নিয়ে আসতে। রাহেলা স্বামীর মাথা হাতিয়ে শান্তনা দিলেন এই বলে,-চিন্তা করো না, আমি বিষয়টা দেখছি।(মঞ্চের লাইট অফ হয়ে যায়, কিন্তু ইংলিশ গান বাজতে থাকে, এবং ওয়া ম্যান, ওয়া ম্যান শব্দ হচ্ছে ছেলের মুখ থেকে)

তৃতীয় দৃশ্য
সিডিতে ইংলিশ গান বাজছে। রাহেলা প্রবেশ করেন ছেলের ঘরে। ছেলে মাকে জড়িয়ে বলতে থাকে,`ওয়া ম্যান, ওয়া ম্যান।রাহেলা ছেলের কর্মে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করেন। ক্ষুব্ধতা প্রকাশার্থে তিনি সিডি বন্ধ করে ধমক দিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাস করেন,-এটা তোমার কোন রকমের বিয়াদবি? তুমি চোখে কি মা-বাবা দেখো নানি? তুমি কি মা-বাবাকে সম্মান করতে শিখনি? গান শোনবে ভালো কথা, কিন্তু ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে না? গান শোন, বাংলা অনেক গান আছে, তা শোনো, এই সব কি রকমের গান? আর `ওয়া ম্যান, ওয়া ম্যান' কি আবার?মায়ের কথা শোনে ছেলে রেগে যায়। মায়ের দিকে চোখ উঠিয়ে খুব রাগ করে বলে,ইট ইজ নাথিং রঙ মাম, ইট ইজ নাথিং রঙ, দিস ইজ মাই পারসোনাল হবিরাহেলাও সাথে সাথে রাগ দেখিয়ে বলেন,-তুমি দয়া করে বাংলায় কথা বলো। ছেলে তখন হাত নাড়িয়ে মায়ের দিকে একটু ঝুকে গিয়ে বলে,-নো মাম, নো, বাংলা ইজ ওয়ার সেকেন্ট ল্যাংগুজ, ইংলিশ ইজ ওয়ার ফাস্ট ল্যাংগুজ। ইংলিশ বলতে আমরা যতো কমফেটেবুল অনুভব করি, বাংলার ক্ষেত্রে ততটুকু নয়। রাহেলা তখন রেগে গিয়ে চিৎকার দিয়ে ছেলেকে বলেন,-সাবধান, মুখ সামলিয়ে কথা বলো, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং ফাস্ট ল্যাংগুজ হলো বাংলা। বাকী সব দ্বিতীয় ল্যাংগুজ।ছেলে মাকে হাত নাড়িয়ে না না বলে,-না মা, না। বাংলাদেশের প্রথম ভাষা কিংবা মাতৃভাষা অথবা রাষ্ট্রিক ভাষা বাংলা হলেও বাংলাদেশের সকল ইংলিশ স্কুলগুলোর প্রথম ভাষা ইংলিশ। আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ইংরেজদের মতো হওয়ার জন্য-ইতো তোমরা এতো টাকা খরচ করতেছো প্রতি মাসে আমার জন্য। এখন আর বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। আমাকে আমার মতো চলতে দাও।রাহেলা শুধু এতোটুকু বলেন,-না, না, তুমি অবশ্যই আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে চলতে হবে। বাসায় আজ থেকে কোন ইংলিশ গান কিংবা কথা চলবে না।। ছেলে ক্ষুব্ধ হয়ে মাকে বলে,-কি বললে মা, তুমি কি পাগল? তোমরাই না এক সময় গর্ব করে মানুষকে বলতে তোমাদের ছেলে খুব ভালো ইংলিশ বলতে পারে। তোমরাই যে আমার সাথে সব-সময় ইংলিশে কথা বলতে। এখন তোমার কি হলো?রাহেলা ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলেকে বার বার জিগ্যাস করেন,`তুমি আমাকে পাগল বলতে পারলে? তুমি আমাকে পাগল বলতে পারলে? স্বার্থক আমার তোমাকে জন্ম দেওয়া।এই সময় ছেলের বাপ প্রবেশ করবেন। মা-ছেলের আলাপের মধ্যখানে,`রাহেলা, তুমি মুখ বন্ধ করে রোমে যাও, ইটা আমরার কপাল। সব দোষ রাহেলা আমার। তুমি একদিন বলেছিলে-ছাগি চেনাইতে না ধরলে পরে ধরা যায় না। আর আমি তোমাকে সেদিন মূর্খ বলে গালি দিয়ে বলে ছিলাম-মানুষ চাঁদে চলে যাচ্ছে। আর আমি তুমি আছো এখনো পুরাতন ছিলক নিয়ে। মূলত আমি কোনদিন চিন্তা করি নি, আমাদের ঐতিহ্যের ছিলকের ভিতর যে জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে। রাহেলা, আমি যদি তোমার কথা মতো প্রথম থেকে তাকে দেশীয় ভাষা-সংস্কৃতি শিক্ষা দিতাম তবে আজ এমন হতো না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন